বর্ণাশ্রম ধর্ম

প্লেটো, গান্ধীজি, ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ও শ্রীল প্রভুপাদের দৃষ্টিতে

লেখক: সত্যরাজ দাস

সম্প্রতি নিউইয়র্ক শহরে এক সচ্ছল ভারতীয় ভদ্রলোকের সাথে আলাপ-আলোচনাকালে আমি দৈবাৎ বলেছিলাম যে, আমি দ্বিতীয় দীক্ষা লাভ করেছি অর্থাৎ ব্রাহ্মণ দীক্ষা। ব্রাহ্মণ দীক্ষিত ভক্ত সাধারণত নিয়মিত গুপ্ত গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে এবং মাঝে মাঝে বৈদিক অনুষ্ঠানাদিতে  পৌরহিত্যের কাজ করে। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কীভাবে সম্ভব! আপনি ভারতেও জন্মগ্রহণ করেননি, আবার ব্রাহ্মণ পরিবারেও জন্মগ্রহণ করেননি, অর্থাৎ আপনার বাবা-মাও ব্রাহ্মণ নন, তবুও আপনি কীভাবে গায়ত্রী জপ করেন?” আমি বললাম, আমার এক হিন্দুু বন্ধু অমরনাথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত যে, ব্রাহ্মণত্ব¡ জন্মগতভাবে প্রাপ্ত হওয়া যায়। অর্থাৎ, এটি জন্মগত অধিকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ভারতে প্রচলিত এক ভ্রান্ত ধারণা।

জন্মগতভাবে ব্রাহ্মণ হওয়ার এ ভ্রান্ত ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে বোঝানোর জন্য আমি লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা সম্পর্কে বোঝানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

ঋক্বেদ সংহিতায় (১০/৯০/১২) মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগসমূহকে তুলনা করা হয়েছে। সাধারণত শরীরের একটা অংশ অন্য অংশের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। তবুও যথাযথভাবে সকল কাজকর্মের জন্য শরীরের সমস্ত অঙ্গগুলো প্রয়োজন। বিষ্ণুপুরাণ (৩.৮.৯) এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৪/১৩) বর্ণাশ্রম সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার একটি স্বাভাবিক অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা হলো চারটি জাগতিক কর্তব্যকর্ম এবং চারটি চিন্ময় অবস্থার সমষ্টি। সেই চারটি বর্ণ হচ্ছে:

                ১. ব্রাহ্মণ (বুদ্ধিমান, পুরোহিত, ধর্মযাজক)

                ২.ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা, প্রশাসক)

                ৩. বৈশ্য (কৃষক ও ব্যবসায়ী)

                ৪. শূদ্র (কায়িক পরিশ্রমী ও ভৃত্য)।

অধিকাংশ লোক গুণ বা যোগ্যতাকে প্রদর্শন করে যা এসমস্ত শ্রেণিবিভাগকে ছাপিয়ে যায়, কিন্তু মানুষের পেশাগত প্রবৃত্তি পরিশেষে প্রাধান্য বিস্তার করে। চারটি আধ্যাত্মিক অবস্থা হলো:

                ১. ব্রহ্মচর্য (অবিবাহিত ছাত্রজীবন)

                ২. গার্হস্থ্য (বিবাহিত জীবন)

                ৩. বানপ্রস্থ (অবসর জীবন অর্থাৎ বিবাহিত জীবনের শেষে)

                ৪. সন্ন্যাস (জড়জাগতিক বিষয়ে অনাসক্তি এবং পরম মুক্তির প্রতি পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ)

কিন্তু এসমস্ত বর্র্ণাশ্রম সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আলোকপাত করা সম্ভব হবে না। অল্প পরিসরে অমরনাথ ও আমার মধ্যেকার আলোচনার বিষয়বস্তু এখানে তুলে ধরা হলো:

বর্ণাশ্রম জন্মগত নয়, গুণগত

উকিলের ছেলে যদি ওকালতিতে পারদর্শী না হয়, শুধু উকিলের ঘরে জন্মগ্রহণ করার জন্য তাকে উকিল বলা যায় না। আবার, ডাক্তারের ছেলে যদি চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষ না হয়, তাহলে তাকে ডাক্তার বলা যাবে না। তেমনি, ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে কেউ যদি ব্রাহ্মণের ন্যায় আচরণ না করে, তাকেও ব্রাহ্মণ বলা যাবে না। আমি অমরনাথকে দেখিয়েছিলাম যে, বৈদিক সংস্কৃতিতে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বা দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করা হয় বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় মানুষকে তার অবস্থান চিহ্নিত করার আগে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ ব্যবস্থাকে বর্তমানকালে বর্ণব্যবস্থার এমন রূপ দিয়েছে যেখানে মানুষকে তার জন্মানুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কেউ যদি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তাকে ব্রাহ্মণ হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু তার যোগ্যতা বিবেচনা করা হয় না। অসংখ্য উপজাত প্রথাসমন্বিত বর্ণব্যবস্থা এ ধরনের ভাসা-ভাসা অবস্থার রূপ পরিবর্তন করেছে। এ ব্যবস্থার ফলে ভারতে ব্যাপক দ্বন্দ্ব, বেসামরিক দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)-এর প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স¦ামী প্রভুপাদ মস্কোতে ড. কটোভস্কির সঙ্গে এক আলোচনায় এ বিষয়টি সুবিখ্যাত ভারতীয় সংস্কৃতির আলোকে ব্যাখ্যা করেছিলেন-

ড. কটোভস্কি: আমার মনে হয় ইউরোপীয়রা সাধারণ ধর্ম বলতে যা বোঝে, হিন্দুধর্ম ঠিক তা নয়; হিন্দুধর্ম জীবনধারার একটি প্রণালী – ধর্ম, দর্শন, সামাজিক রীতি, আপনি যা চান তা-ই তাতে পাবেন। 

শ্রীল প্রভুপাদ: ভারতবর্ষের প্রকৃত সাংস্কৃতিক প্রথাকে বলা হয় বর্ণাশ্রম। তাতে আছে চারটি বর্ণ- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এবং চারটি আশ্রম- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। বৈদিক প্রথা অনুযায়ী, যতক্ষণ না মানুষ এ চারটি বর্ণ এবং চারটি আশ্রমের অন্তুর্ভুক্ত হয়ে জীবনযাপন করছে, ততক্ষণ তাকে সভ্য মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। মানুষকে এ চারটি সামাজিক বিভাগ ও চারটি আধ্যাত্মিক আশ্রয় নিতেই হবে। একেই বলে বর্ণাশ্রম। ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি এই অতি প্রাচীন বৈদিক প্রথার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। 

ড. কটোভস্কি: বর্ণাশ্রম!

শ্রীল প্রভুপাদ: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৪/১৩) বলা হয়েছে “চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ” অর্থাৎ “প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে মানব-সমাজে আমি এ চার বর্ণ সৃষ্টি করেছি।” যেহেতু বর্ণাশ্রম স্বয়ং ভগবানের সৃষ্টি, তাই তা অপরিবর্তনীয়। এর প্রভাব সর্বত্রই দেখা যায়। এটি হচ্ছে সূর্যের মতো। সূর্য যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত সব জায়গাতেই আলো দেয়, বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রভাবও ঠিক তেমনই; সব জায়গাতেই কোনো না কোনোভাবে বর্তমান রয়েছে। যেমন ধরুন, ব্রাহ্মণেরা অর্থাৎ সমাজের সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকেরা হচ্ছে সমাজের মস্তিষ্ক। ক্ষত্রিয়রা হচ্ছে পরিচালক গোষ্ঠী। বৈশ্যরা হচ্ছে উৎপাদক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং শূদ্ররা হচ্ছে শ্রমিক সম্প্রদায়। এ চারটি শ্রেণিবিভাগ বিভিন্ন স্থানে সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়।

ড. কটোভস্কি:  আমার মনে হয় প্রাচীন সমাজে এই বর্ণাশ্রম ধর্ম একটি স্বাভাবিক শ্রেণিবিভাগ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আজকের যেকোনো সমাজে শ্রম-বণ্টনের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করা খুবই জটিল এবং বিভ্রান্তিকর। তাই এখন সমাজকে এ চার শ্রেণিতে বিভক্ত করতে গেলে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। 

শ্রীল প্রভুপাদ: বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীকালে, যখন ব্রাহ্মণরা সন্তানের গুণ না থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ব্রাহ্মণত্ব দাবি করল এবং লোকজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে সেই দাবিকে সামাজিক রীতি বলে মনে করে তাদের ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করল। তার ফলেই ভারতীয় সমাজব্যবস্থার মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল।

   অর্থাৎ, উপরিউক্ত কথোপকথনে শ্রীল প্রভুপাদ দেখিয়েছেন, কীভাবে আমরা সকলেই বর্ণাশ্রম অনুসরণ করছি এবং গীতার সিদ্ধান্ত অনুসারে, জন্মগত বিচারে নয়, পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা তাঁদের নিজেদের সুবিধার জন্য বর্ণাশ্রমের এ পন্থাকে জন্মগত বলে প্রচার করেছেন।

  গান্ধীজি বলেছেন- বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় গুণ ও কর্মের ওপর জোর দেয়া হয়, কিন্তু জন্মের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয় না। মানুষ তাদের যোগ্যতা বা গুণ অনুসারে কোনো বিশেষ শ্রেণিতে অবস্থান করে, কিন্তু সেটা তার বিশেষ পরিবারে জন্ম অনুসারে নয়। জন্ম কেবল সহায়ক হতে পারে, কিন্তু তা কখনো কোনো ব্যক্তির পেশা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একমাত্র বিষয় হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বিচারক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, সেটা তাকে তার জীবনে সুশিক্ষা প্রদান করতে পারে এবং কারিগরি প্রবৃত্তি সরবরাহ করতে পারে। তাই বলে তা বিচারকত্ব পেশা নিশ্চিত করে না। তাছাড়া শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে, গুণ ও কর্ম হচ্ছে বর্ণাশ্রম ধর্মের ভিত্তিস্বরূপ। তা সত্ত্বেও অল্প কিছুলোক সে সম্পর্কে জানে।

   অমরনাথ জোর দিয়ে বলেছেন, আদি বৈদিক শাস্ত্রসমূহ এবং এসমস্ত শাস্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীল প্রভুপাদ সমর্থন করতে পারেন যে, গুণ ও কর্ম অনুযায়ী বর্ণাশ্রম করা হয়। কিন্তু তাঁর মতে, আধুনিক হিন্দুত্ববাদ ভিন্ন কথা বলছে। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, আজকের অধিকাংশ ভারতীয় বলে যে, বর্ণাশ্রম বলতে জন্মাধিকারকে বোঝায়। আমরা উভয়ে বিস্ময়ে বলতে লাগলাম, তারা কীসের ওপর ভিত্তি করে তা বলে! এমনকি গান্ধীজি, যাঁকে হিন্দুধর্মের এক অন্যতম পুরোধা বলে বিবেচনা করা হয়; তিনি গুণ ও কর্মকে সমর্থন করে বলেছেন- বর্ণাশ্রমকে সাধারণত জন্মানুসারে চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু শুধু এর দায়-দায়িত্ব অনুসারে এটাকে বজায় রাখা হয়। একজন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে তাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়, কিন্তু সে যদি তার প্রাপ্ত বয়সে ব্রাহ্মণের গুণাবলি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে ব্রাহ্মণ বলা যাবে না। তাকে ব্রাহ্মণের পদ থেকে অপসারিত করতে হবে। কিন্তু পক্ষান্তরে, কেউ যদি তার কাজকর্মে ব্রাহ্মণের গুণাবলি প্রকাশ করতে পারে, সে যদি ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ না-ও করে, তবু তাকে ব্রাহ্মণ বলে বিবেচনা করা হবে ।

স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক বিভাজন ঘটে, কিন্তু একে কোনোভাবেই জন্মসূত্রের মাধ্যমে করা হয় না। কৃষ্ণভাবনামৃতের এক বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব এবং অন্যতম আচার্য শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর (১৮৩৮-১৯১৪) দেখিয়েছেন, সমগ্র সমাজে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা কীভাবে সৃষ্টি হয়। তিনি বলেছেন- যদি আমরা ইউরোপের আধুনিক সমাজের কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, তাদের সমাজে যে ধরনের সৌন্দর্যই থাকুক না কেন, এসব সমাজ তাদের স্বাভাবিক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। ইউরোপে যাদের ব্যবসায়িক গুণাবলি রয়েছে, তারা ব্যবসায় পছন্দ করে এবং তাদের ব্যবসায়ের মাধ্যমে উন্নতি করানো হয়। যাদের ক্ষত্রিয়ের গুণ আছে, তারা সৈনিক জীবন গ্রহণ করে এবং যাদের শূদ্রের গুণ থাকে, তারা শারীরিক শ্রম পছন্দ করে। কিন্তু ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বর্তমানকালে প্রচলিত বর্ণপ্রথাকে সমালোচনা করেছেন। বিশেষত যেখানে জন্মগ্রহণকে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি লিখেছিলেন- প্রকৃত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা বিশুদ্ধ এবং তা বৈজ্ঞানিক নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে হয়েছে। তিনি আরো লিখেছেন- মহাভারতের সময়কাল (প্রায় ৫০০০ বছর পূর্ব) থেকেই এ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা এর প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যূত হয়। এ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধীরে ধীরে মানুষকে ভগবানকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে অগ্রগতি করতে সাহায্য করা। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ঐ ব্যবস্থাকেই প্রকৃত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা বলেছেন, যা আধ্যাত্মিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

   তিনি বলেন, ‘দৈবী বর্ণাশ্রম’, যা বর্তমানকালের বর্ণপ্রথা থেকে অনেক দূরের বিষয়। শ্রীল ভীক্তবিনোদ ঠাকুরের দৈবী বর্ণাশ্রম অনুসারে বর্তমানে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ পরিচালিত হচ্ছে। দৈবী বর্ণাশ্রমের এ পন্থা অনুসারে একই ব্যক্তি বিভিন্ন সময় উপযোগিতা অনুসারে বিভিন্ন সেবাকার্য সম্পাদন করছে, এ সংস্থার মন্দিরগুলোতে একই ভক্ত ব্রাহ্মণ হিসেবে প্রয়োজনে পূজাও করতে পারে, আবার প্রশাসনিক কার্য তথা মন্দির ব্যবস্থাপনা করতে পারে, আবার প্রয়োজনে ঝাড়– দিতে পারে বা মন্দিরের বিভিন্ন দ্রব্যাদি বিক্রি করতে পারে। আবার, গৃহস্থরা একইসাথে তাদের ব্যবসা বা চাকরি করছে, আবার গৃহে ফিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের অর্চন করছে। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যায়, এখানে বর্ণাশ্রমের কোনো ভেদাভেদ নেই- সবই ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সেবাকার্য। তাই দৈবী বর্ণাশ্রম অনুসারে সমাজে কোনো বর্ণভেদ বা জাতিভেদের কোনো সম্ভাবনা নেই। কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে আমরা দেখতে পাই, এখানে কোনো বর্ণাশ্রমের ভেদাভেদ নেই, অথচ সকলেই ভগবদ্প্রদত্ত বর্ণাশ্রমের অনুসরণ করছে; কোনো সেবাকেই ছোট করে দেখা হচ্ছে না। এটাই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের দৈবী বর্ণাশ্রমের উৎকর্ষ।

   ভক্তিবিনোদ ঠাকুর পাশ্চাত্য দেশের সমাজব্যবস্থার বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, যদিও ইউরোপের জাতিগুলো অনেকাংশে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা অনুসরণ করে, কিন্তু তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। ভারত বাদে ইউরোপ এবং অন্যান্য সমস্ত দেশ যে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা পালন করে তা অবৈজ্ঞানিক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এ ব্যবস্থার প্রতি এখানে তাঁর মূল্যায়ন প্রকাশ করেছেন, যেহেতু তা বৈদিক বিষয়কে ব্যাখ্যা করে- যেখানে কেউ একটি সমাজে অবস্থান করে সেই সমাজের অংশ নির্ধারণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ব্যাখ্যা করে।

   সংক্ষেপে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বৈদিক ব্যবস্থাসমূহ ব্যাখ্যা করেন- ১. বাল্যকালে শিশুর কোনোকিছু শেখার প্রতি তার সঙ্গ এবং প্রবণতা পরীক্ষা করার পর তার বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে বর্ণ নির্ধারণ করা উচিত, ২. বর্ণ নির্ধারণের সময় মা-বাবার বর্ণও কিছুটা বিবেচনা করা উচিত, ৩. জ্ঞান লাভ করার সময় বর্ণ নির্ধারণ করা উচিত পরিবার, ধর্মযাজক, বাবা, সম্মানিত গুরুজন এবং পূর্বতন আচার্যবর্গের মাধ্যমে, ৪. মামলার ক্ষেত্রে দু’বছর বিচারাধীন সময় থাকবে এবং একটি পর্যবেক্ষক কমিটি থাকবে ঐ সময় পরে মামলাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বিবেকবর্জিত এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সম্বন্ধে লিখেছেন- যারা অন্যের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করার জন্য মনুসংহিতা ও অন্যন্য ধর্মশাস্ত্র পুনরায় লিখেছেন, যাতে ব্রাহ্মণত্ব গুণের সুবিদিত যোগ্যতার ক্ষেত্রে জন্ম অধিকারকে অনুমোদন করে। তিনি লিখেছেন, এ বিবেকবর্জিত  সিদ্ধান্ত ভারতীয় গৌরবময় সমাজের পতন বয়ে এনেছে।

  গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে সমাজ বিভাজনের বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। তিনি তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বলেছেন, ব্যক্তিত্বের ধরন অনুযায়ী সামাজিক শ্রেণিবিভাগ হয়। তিনি বলেছেন, এ শ্রেণিবিভাগ দার্শনিক জ্ঞান-গরিমার দ্বারা প্রভাবিত এবং তা সর্বশ্রেষ্ঠ। তারপর যেগুলো আসে সেগুলো আবেগ দ্বারা প্রভাব বিস্তার করে এবং পরিশেষে আমরা এ বিভাজনকে জৈবিক আকাক্সক্ষার মাধ্যমে দেখতে পাই। প্লেটো আরো বলেন, যেকোনো ব্যক্তি দেখতে পাবে যে, সমাজ স্বাভাবিকভাবে একই উপায়ে বিভাজিত। সবার উপরে হচ্ছেন দার্শনিকগণ যাঁরা আদেশ-উপদেশ দিবেন। তার নিচে হলো যোদ্ধা, যাদের তিনি সহায়তাকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু যোদ্ধারা রাজাকে সাহায্য করে, সেহেতু প্লেটো ব্যবসায়ী ও শ্রমিককে একটি ভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজিত করেছেন। তিনি রাজাকে স্বর্ণের সাথে, যোদ্ধাকে রূপার সাথে এবং ঐ তৃতীয় শ্রেণিকে পিতল এবং লোহার সাথে তুলনা করেছেন। প্লেটোর মতে, বিদ্বান বাবা-মা চাইবেন বিদ্বান ছেলেমেয়ে, যোদ্ধা বাবা-মা চাইবেন তাদের মতো যোদ্ধা-গুণসমন্বিত সন্তান। এভাবে যার-যার গুণ অনুযায়ী সে ধরনের সন্তান চাইবেন। কিন্তু বিদ্বান বাবা-মায়ের যোদ্ধা, ব্যবসায়ী বা শ্রমিক গুণসম্পন্ন সন্তানও হতে পারে। প্লেটো বললেন, যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, তখন স্বীকৃতি দেবার সময় অনেক শিথিলতা থাকবে। যেমন- শ্রমিক বাবা-মা একজন জ্ঞানী শিশুর জন্মদান করলেন, তখন তাকে জ্ঞানী বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। এক্ষেত্রে তার জন্ম-পরিচয় বাদ দিয়ে তার স¦াভাবিক গুণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রভুপাদের শিক্ষার সাথে প্লেটোর শিক্ষা মিলে যায় এক্ষেত্রে। উভয়েই বলেছেন, জন্ম-পরিচয়ই শুধু একক শর্ত নয়, বরং তা ব্যক্তিকে কোনো বিশেষ জায়গায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। প্রভুপাদ বললেন, কেউ অনায়াসে ব্রাহ্মণ হতে পারে না, যদিও সে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে; বরং ব্রাহ্মণ হিসেবে নিজেকে তৈরি করার ভালো সুযোগ থাকতে পারে, যদি তার বাবা ব্রাহ্মণ হয়। ঠিক যেমন কারো বাবার পেশা যদি মুচি বা সংগীত হয়, তাহলে তার সন্তানের ঐ গুণ অর্জনের ভালো সুযোগ তৈরি হয়। এমন নয় যে, মুচি ব্রাহ্মণ হতে পারবে না। যদি সে ব্রাহ্মণের গুণগুলো অর্জন করে, তাহলে সে ব্রাহ্মণ বলে বিবেচিত হয় ।

 কৃষ্ণসেবার জন্য বর্ণ

অমরনাথ এ মতামত স্বীকার করেন। বৈদিক শাস্ত্র এবং আধুনিক প্রতিনিধিগণ, যেমন- ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শ্রীল প্রভুপাদ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক উপকারী এবং ভগবানের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করার একটি ভিত্তি হিসেবে অনুমোদন করেন। এমনকি গান্ধীজি, প্লেটো- তাঁরাও বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে স্বীকার করেছেন। এমনকি তাঁরা বলেছেন, এ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ব্যক্তির সহজাত গুণ ও স্বাভাবিক বৃত্তির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, পারিবারিক মর্যাদা বা জন্মসূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আমরা এটা স্বীকার করি যে, কোনো বিশেষ গুণসমন্বিত পরিবারে জন্ম হলে তা অনেক সহায়তা করতে পারে। কারণ, কাউকে যদি জন্ম থেকে কোনো কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে শিক্ষিত করা হয়, তখন সে ঐক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষতা লাভ করতে পারবে। আমরা লক্ষ্য করেছিলাম যে, আমাদের আলোচনার একটি বিষয়ে অমরনাথ বিরক্ত হয়েছিল, কিন্তু তাকে মেনে নিতে হয়েছিল যে, উপরোক্ত মতামতটি সত্য। বিশ্ব ইতিহাসের এ বর্তমান যুগে (বিশেষত কলিযুগে- কলহ এবং প্রতারণার যুগ) প্রকৃত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা জাতি ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এর কারণ, ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়গণ প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও গুণাবলি বৃদ্ধি না করে শুধু তাদের  মর্যাদা রক্ষা করতে চেয়েছিল। তারা প্রতারকের মতো জন্ম-অধিকারের ওপর জোর দিয়েছিল এবং জোরপূর্বক সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের ক্ষমতা বজায় রেখেছিল, যার ফলে একটা শোষিত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যা বর্তমান সমাজব্যবস্থার সঙ্গে মিশে গেছে।

   অমরনাথ জিজ্ঞেস করেছিল, “কী করা যায়?”। তার প্রতিউত্তরে আমি তাকে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের মূলমন্ত্র সম্পর্কে বলেছিলাম। একেক ব্যক্তির বৃত্তি বা কর্ম অনুসারে সঠিক কাজের মাধ্যমে ভগবানের সেবার প্রতি মানুষের প্রবণতার অগ্রগতি ধীরে ধীরে সাধিত হয়। যে কেউ এ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা সঠিকভাবে পালন করে ব্রাহ্মণ স্তরে বা আরো উন্নত বৈষ্ণব স্তরে বা ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের স্তরে উন্নীত হতে পারে। বৈষ্ণবগণ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও তার ঊর্ধ্বে। তাঁরা ভগবান প্রদত্ত প্রতিভাসমূহকে কৃষ্ণসেবায় নিয়োজিত করেন, যা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। কিন্তু তাঁরা সমস্ত আশ্রম সমভাবে গ্রহণ করে কৃষ্ণসেবার নিমিত্তে পরিচালিত করেন। একেই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর দৈবী বর্ণাশ্রম বলেছেন।

   শ্রীল প্রভুপাদ মহাভারত থেকে একটি গল্পের অবতারণা করেছেন যা ‘জাদুর পুকুর’ নামে অভিহিত। যুুধিষ্ঠির মহারাজ সুন্দর ও নির্মল পুকুর থেকে জল পান করার পূর্বে তাঁকে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। তার একটি প্রশ্ন ছিল, প্রকৃত ব্রাহ্মণ কীভাবে হওয়া যায়? তা কি জন্ম, শিক্ষা বা সদ্ব্যবহারে হয়? যুধিষ্ঠির মহারাজ উত্তর দিলেন, জন্মসূত্র এবং শ্রেষ্ঠ জ্ঞান মানুষকে ব্রাহ্মণ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না, কিন্তু সদাচার তা করতে পারে। সুতরাং, শুধু কর্মের মাধ্যমে যে কেউ আধ্যাত্মিক জীবনের স্তরে উন্নীত হতে পারে। এ গল্পে জন্ম পরিচয়ের কথা কোনোভাবেই উল্লেখ করা হয়নি এবং এ জন্ম পরিচয় কেবল একটা সংকীর্ণ বিবেচনা। অমরনাথ বুঝতে পারল। সে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে আমরা অন্যদের এটা বোঝাতে পারি? আমি তাকে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ পড়ার বিষয়ে বলেছিলাম, যে গ্রন্থগুলোতে তারা সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সারবস্তু খুঁজে পাবে এবং তার সাথে-সাথে গন্ধীজি ও প্লেটোর মতো চিন্তাবিদদের মূল্যবান দর্শন সম্বন্ধে জানতে পারবে। -হরেকৃষ্ণ।

ভাষান্তর: সুনন্দ কেশব দাস

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *