শিবতত্ত্ব ও শিবের আবির্ভাব রহস্য

লেখক: সুদর্শন নিমাই দাস

(আবির্ভাব দাস- ছদ্মনাম)………………………….

বৈদিক শাস্ত্রে শিব এক রহস্যময় চরিত্র। কোথাও তিনি পরমেশ্বর সদাশিব, কোথাও পরম বৈষ্ণব, কোথাও তিনি ধ্বংসের দেবতা রুদ্র। আবার শিবলিঙ্গরূপেও তাঁর বিবিধ লীলা শাস্ত্রে বর্ণিত রয়েছে। জড় সৃষ্টির জন্য কখনো তিনি বিষ্ণুর ললাট থেকে প্রকাশিত; কখনো বা ব্রহ্মার ভ্রূ-যুগল থেকে। আবার কারো মতে শিবের জন্মই নেই, তিনি নিত্য প্রকাশিত। তাই শিব সম্বন্ধে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি আর বিতর্কের যেন অন্ত নেই। সেজন্য প্রথমত শিবতত্ত্ব সম্বন্ধে যথার্থরূপে জানা আবশ্যক। ত্রৈমাসিক অমৃতের সন্ধানের জানুয়ারি—ফেব্রুয়ারি-মার্চ-২০১৫ সংখ্যায় শিবলিঙ্গ প্রসঙ্গে এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ—২০২১ সংখ্যায় শিবতত্ত্ব বিষয়ে চমৎকার উপস্থাপনা রয়েছে। তাই উক্ত বিষয়ের তেমন পুরাবৃত্তি ও বিশদ আলোচনা না করে এই প্রবন্ধে শিবতত্ত্ব সংক্ষেপে বর্ণনপূর্বক শিবের আবির্ভাব রহস্য আলোচনা করা হয়েছে।

শিবের প্রকৃত তত্ত্ব

শিবের দুই ধরনের প্রকাশ— ১. সদাশিব এবং ২. রুদ্রশিব। সংহারকারী শিব ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণাবতার। তিনি সদাশিবরূপী বিষ্ণুর অংশ। শ্রীল চক্রবত্তীর্ ঠাকুর শ্রীভাগবতামৃত-কণার ৫ম অনুচ্ছেদে শ্রীশিব, সদাশিব ও স্বয়ং ভগবান সম্বন্ধে এরূপ সিদ্ধান্ত করেছেন— “সদাশিবঃ স্বয়ংরূপাঙ্গবিশেষস্বরূপো নিগুর্ণঃ সঃ শিবস্যাংশী। অতত্রবাস্য ব্রহ্মতোহপ্যধিক্যং বিষ্ণুনা সাম্যঞ্চ জীবাত্তু সগুণত্বেহসাম্যঞ্চ।” অর্থাৎ, “যিনি বৈকুণ্ঠধামে সদাশিবরূপে বিরাজিত, তিনি গুণাবতার-শিব নন, তিনি নিগুর্ণ এবং স্বয়ংরূপ শ্রীকৃষ্ণেরই অঙ্গবিশেষ। এই সদাশিব গুণাবতার-শিবের অংশী। অতএব, ব্রহ্মা হতে শ্রেষ্ঠ এবং বিষ্ণুর সাথে সমান। জীব সগুণ বলে জীব হতে এঁর ভেদ স্বীকার করতে হবে।”

শিবতত্ত্ব সম্বন্ধে সবচেয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে শ্রীব্রহ্মসংহিতায়। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকৃত তাৎপর্য অনুসারে, শিব মূলতত্ত্বে ভগবত্তত্ত্ব। বৈকুণ্ঠের অন্তর্গত শিবধামে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু শ্রীসদাশিবরূপে অবস্থান করেন। এই সদাশিব পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিলাসবিগ্রহ নারায়ণ থেকে অভিন্ন। তাই বিষ্ণু ও সদাশিবে মূলত কোনো ভেদ নেই। অর্থাৎ, সদাশিব মূলত বিষ্ণুই। কেবল কনিষ্ঠ স্তরের ভক্তরাই সদাশিব ও বিষ্ণুতে ভেদ দর্শন করে বিতর্কের সৃষ্টি করে। গুণাবতার-শিবের অংশী এই বিষ্ণুতত্ত্ব-সদাশিবই বৃন্দাবনে ‘গোপেশ্বর’ নামে খ্যাত। তিনি শুদ্ধবৈষ্ণবগণের দ্বারা পূজিত। এমনকি তামসশাস্ত্রেও শিব সম্পর্কে যে পরতত্ত্বসূচক শব্দাদি প্রযুক্ত হয়েছে, তা প্রকারান্তরে সদাশিবরূপী বিষ্ণু সম্পর্কেই প্রযুক্ত।

কপূর্রের ন্যায় গৌরবর্ণ সদাশিব গুণাতীত পরমেশ্বর। তিনি জন্মমৃত্যুর অতীত। কিন্তু জড়জগতের সৃষ্টির জন্য মহাবিষ্ণুর ইচ্ছায় শিব যখন শম্ভু, রুদ্র প্রভৃতি রূপে প্রকাশিত হন, তখন তাঁর সেই রূপ পরমেশ্বরের সঙ্গে যুগপৎ ভেদ ও অভেদ তত্ত্ব। তিনি স্বতন্ত্র ঈশ্বর নন। আবার যেহেতু তাঁর মধ্যে সাধারণ জীবের পঞ্চাশটি গুণের অতিরিক্ত কিছু গুণাবলি (যেমন—সর্বজ্ঞ) এবং ব্রহ্মা অপেক্ষাও অধিক কিছু গুণাবলি বিদ্যমান, তাই তাঁকে সরাসরি জীবও বলা যায় না। বিষ্ণুতত্ত্ব—প্রকাশসমূহকে বলা হয় স্বাংশ এবং জীবকে বলা হয় বিভিন্নাংশ। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের ভাষায়— শ্রীশিব তথা রুদ্র হলেন স্বাংশ প্রভাববিশিষ্ট বিভিন্নাংশ।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, যদি তিনি বিষ্ণু থেকে অভিন্ন পরমেশ্বর হন তাহলে তাঁকে বৈষ্ণব বলা হয় কেন। কয়েকটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিষয়টি বোঝা যায়। যেমন, বলরাম শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন পরমেশ্বর, অনন্তশেষও ভগবানের অংশ; কিন্তু তাঁদের মধ্যে সর্বদা ভক্তভাব— “আমি শ্রীকৃষ্ণের সেবক”। একইভাবে সদাশিব বিষ্ণু থেকে অভিন্ন হলেও তাঁর মধ্যে সর্বদা ভক্তভাব বিরাজমান— আমি শ্রীকৃষ্ণের, শ্রীবিষ্ণুর সেবক। তাই শিবকে সর্বদা পরমেশ্বরের ধ্যানে মগ্ন থাকতে দেখা যায়। শ্রীমদ্ভাগবতে স্পষ্টই উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি ভগবান সংকর্ষণরূপী বিষ্ণুর ধ্যান করেন।

এছাড়া গুণাবতার শিব বা রুদ্ররূপে তিনি বিষ্ণুর আজ্ঞাবহ সেবক হিসেবে ধ্বংসকার্য সম্পাদন করেন। বিষ্ণুর স্বাংশ-প্রভাববিশিষ্ট বিভিন্নাংশ শিব ভগবানের দ্বারা শক্তিপ্রাপ্ত বলে তাকে আধিকারিক দেবতাও বলা হয়। আধিকারিক অর্থ যাকে অধিকার দেয়া হয়েছে। তিনি পরমেশ্বর ভগবান নন, আবার ভগবান থেকে স্বতন্ত্রও নন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেন— “শম্ভু কৃষ্ণ হতে পৃথক অন্য একটি ‘ঈশ্বর’ নন। যাদের সেরূপ ভেদ-বুদ্ধি, তারা ভগবানের নিকট অপরাধী। শম্ভুর ঈশ্বরতা গোবিন্দের ঈশ্বরতার অধীন। সুতরাং, তাঁরা বস্তুত অভেদ—তত্ত্ব। শ্রীল প্রভুপাদ বলেন (ভা.৪.৬.৪২ তাৎপর্য)— ভগবান শ্রীবিষ্ণু এবং শিবের মূল স্থিতিতে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিব বিষ্ণু থেকে ভিন্ন। এই ভেদ-অভেদ-তত্ত্বের লক্ষণ ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৪৫) উল্লেখ করা হয়েছে—

ক্ষীরং যথা দধি বিকারবিশেষযোগাৎ

সঞ্জায়তে ন হি ততঃ পৃথিগস্তি হেতোঃ।

যথা শম্ভূতামপি তথা সমুপৈতি কার্যাদ্।

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।

অর্থাৎ, দুধ যেরূপ বিকার বিষেশযোগে দইয়ে পরিণত হয়, তবুও দুধ থেকে পৃথক তত্ত্ব হয় না, সেরূপ যিনি কার্যবশত ‘শম্ভুতা’ প্রাপ্ত হন (অর্থাৎ শিবরূপে প্রকাশিত হন), সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”

দুধ বিকারগ্রস্ত হয়ে দধি হয়, কিন্তু বিষ্ণু অবিকারী। তাই কারো কাছে উপমাটি অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু শাস্ত্রবাক্য অভ্রান্ত। বাংলা ব্যাকরণের সাধারণ জ্ঞান যাদের আছে, তারা জানেন যে, উপমেয় (যাকে তুলনা করা হয়) বস্তু সর্বদাই যে উপমান (যার সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর তুলনা করা হয়)—এর সাথে শতভাগ সমধর্মবিশিষ্ট থাকবে এমন নয়। যেমন, মুখচন্দ্র— মুখ চন্দ্রের ন্যায়। এখানে, মুখ উপমেয় এবং চন্দ্র উপমান। এতে সাধারণ কোনো ধর্ম বা বৈশিষ্ট উল্লেখ নেই। চাঁদ এবং মুখ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মবিশিষ্ট। তথাপি এই উপমাসূচক শব্দ সঠিক। আবার, যদি বলি, তুষারশুভ্র— তুষারের ন্যায় শুভ্র। এখানে কেবল তুষারের একটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে তুলনা করা হচ্ছে— শুভ্রতা। তেমনি উপরোল্লেখিত উপমায় দুধ ও দইয়ের কেবল দু’একটি ধর্ম নেয়া হয়েছে—  তা হলো দুধ ও দইয়ের যুগপৎ ভিন্নতা ও অভিন্নতা। “দুধই দধিতে পরিণত হয়, কিন্তু দুধ এবং দইয়ের উপাদান এক হলেও তাদের ক্রিয়া ভিন্ন। তেমনই, শিব যদিও বিষ্ণুর অংশ, কিন্তু তবুও সংহারকার্যে যুক্ত থাকায় তিনি পরিবর্তিত হন বলে মনে করা হয়, ঠিক যেমন দুধ দধিতে পরিণত হয়।” * শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের (আদি ৬.৭৯) তাৎপর্যে

আবার, দুধ থেকে দই কার্যত পৃথক হলেও, যেহেতু দুধই দধিতে পরিণত হয়, তাই, দই কখনো দুধ থেকে স্বতন্ত্র নয়। দুধ যেমন অম্লযোগে দধি হয়, তেমনি বিষ্ণু কারণ বিশেষে শিবরূপ হন। তাই শিব ও বিষ্ণু কার্যত ভিন্ন হলেও, শিব কখনো বিষ্ণু থেকে স্বতন্ত্র নন। শিবের অস্তিত্ত্ব বিষ্ণুর ওপরই নির্ভরশীল, ঠিক যেমন দইয়ের অস্তিত্ব দুধের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং, শিবতত্ত্ব বোঝার জন্য উপমাটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত, নিভুর্ল ও প্রাসঙ্গিক।

শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে মধ্যলীলায় (২০/৩০১-৩১১) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিবতত্ত্ব নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেছেন—

ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব তিন গুণ-অবতার।

ত্রিগুণ অঙ্গীকরি করে সৃষ্ট্যাদি ব্যবহার ।।৩০১।।

নিজাংশ—কৃষ্ণ তমো—গুণ অঙ্গীকারে।

সংহারার্থে মায়া—সঙ্গে রুদ্র—রূপ ধরে ।।৩০৭।।

মায়াসঙ্গ—বিকারী রুদ্র—ভিন্নাভিন্ন রূপ।

জীবতত্ত্ব নহে, নহে কৃষ্ণের ‘স্বরূপ’ ।।৩০৮।।

দুগ্ধ যেন অম্লযোগে দধিরূপ ধরে।

দুগ্ধান্তর বস্তু নহে, দুগ্ধ হৈতে নারে ।।৩০৯।।

‘শিব’—মায়াশক্তিসঙ্গী তমোগুণাবেশ।

মায়াতীত, গুণাতীত ‘বিষ্ণু’— পরমেশ ।।৩১১।।

অর্থাৎ, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অংশের কলায় (অংশের অংশ) তমোগুণ অঙ্গীকার করে জড় জগৎকে সংহার করার জন্য রুদ্ররূপ ধারণ করেন। রুদ্রের বিভিন্ন রূপ মায়ার সঙ্গ প্রভাবে বিকার প্রাপ্ত হয়েছে। রুদ্র জীবতত্ত্বও নন, আবার তিনি শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপও নন। ঠিক যেমন দুধ অম্লের সংযোগে দধিতে পরিণত হয়। যদিও দই মূলত দুধই, কিন্তু তবু তা কখনো দুধ হতে পারে না। রুদ্ররূপে শিব মায়ার সঙ্গী, তাই তিনি তমোগুণের দ্বারা আবিষ্ট। কিন্তু বিষ্ণু সর্বদাই মায়ার অতীত এবং গুণের অতীত, তিনি পরমেশ্বর ভগবান।

জড়জগতে শিবের প্রকাশ

জড়জগৎ সৃষ্টির জন্য পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে তাঁর পুরুষাবতার মহাবিষ্ণুরূপে প্রকাশিত হন। মহাবিষ্ণু যখন জড় সৃষ্টির ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তাঁর সূক্ষ্মরূপা বহিরঙ্গা শক্তি জড়াপ্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। কৃষ্ণাংশ মহাবিষ্ণুর ইচ্ছায় তাঁর চিন্ময় দৃষ্টিপাতের ফলে কালশক্তিরূপে জ্যোতির্ময় শম্ভুলিঙ্গ প্রকাশিত হয় এবং জড়া প্রকৃতির তথা মায়ার সংস্পর্শে আসেন। সেই কালের প্রভাবে মায়াশক্তি জড়সৃষ্টির উপাদানসমূহ প্রকাশ করেন, যা সূক্ষ্মরূপে মহাবিষ্ণুর শরীরে বিদ্যমান ছিল। এই শম্ভু শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুগপৎ ভেদ—অভেদ তত্ত্ব। ব্রহ্মসংহিতায় উক্ত শ্লোকটি এই শম্ভু সম্পর্কেই বলা হয়েছে।

রুদ্ররূপে শিবের আবির্ভাব

সেসব উপাদানে সৃষ্ট অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডবীজ কারণোদকশায়ী মহাবিষ্ণুর লোমকূপ থেকে প্রকাশিত হয়। মহাবিষ্ণু গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।

বামাঙ্গাদসৃজদ্বিষ্ণুং দক্ষিণাঙ্গাৎ প্রজাপতিম্।

জ্যোতির্লিঙ্গময়ং শম্ভুং কুর্চদেশাদবাসৃজৎ।। (ব্রহ্মসংহিতা ৫.১৫)

“সেই গর্ভোদকশায়ী মহাবিষ্ণু স্বীয় বামাঙ্গ হতে (ক্ষীরোদকশায়ী) বিষ্ণুকে, দক্ষিণাঙ্গ হতে প্রজাপতিকে এবং কুর্চদেশ অর্থাৎ ভ্রূদ্বয়—মধ্য হতে জ্যোতির্লির্ঙ্গময় শম্ভুকে সৃষ্টি করেন।”

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকৃত তাৎপর্য অনুসারে, মহাবিষ্ণুসদৃশ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর দক্ষিণাঙ্গ হতে যিনি প্রকাশিত হন, হিরণ্যগর্ভরূপ সেই ভগবদংশই প্রজাপতি (প্রজাগণের পতি); তিনি চতুমুর্খব্রহ্মা হতে পৃথক; এই হিরণ্যগর্ভই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেক ব্রহ্মার বীজতত্ত্ব। সৃষ্টিকার্যের জন্য গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম জীব ব্রহ্মার জন্ম হয়।

শ্রীমদ্ভাগবতের ৩য় স্কন্ধে বর্ণিত আছে— ভগবানের নির্দেশে প্রজাসৃষ্টির জন্য ব্রহ্মা প্রথমে সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামে চারজন মহর্ষিকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন ঊর্ধ্বরেতা এবং জড়জাগতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে অনিচ্ছুক। ব্রহ্মা মহর্ষিদের সৃষ্টি করে তাঁদের বললেন— “হে পুত্রগণ, এখন তোমরা প্রজা সৃষ্টি করো”। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হওয়ার ফলে, মোক্ষনিষ্ঠ কুমারেরা সে কার্যে তাঁদের অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাঁদের পিতার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করার ফলে, ব্রহ্মার অন্তরে দুর্বিষহ ক্রোধ উৎপন্ন হয়েছিল। যদিও তিনি তাঁর ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করেছিলেন, তবুও তা তাঁর ভ্রম্নর মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছিল, যা তৎক্ষণাৎ নীল-লোহিত বর্ণের একটি শিশু রূপে প্রকাশিত হয়। শ্রীল প্রভুপাদ বলেন (ভা. ৩.১২.৭ তাৎপর্য)— “ক্রোধ রজো ও  তমোগুণ থেকে উৎপন্ন হয়, তাই তার বর্ণ নীল (তমোগুণ) ও লোহিত (রজোগুণ)।” তাঁর জন্মের পর তিনি ক্রন্দন করতে করতে বলতে লাগলেন— “হে বিধাতা, হে জগ˜গুরু, দয়া করে আপনি আমার নাম ও স্থানসমূহ নির্দেশ করে দিন।” ব্রহ্মা তাঁকে শান্ত করে বললেন, “হে সুরশ্রেষ্ঠ, যেহেতু তুমি উৎকণ্ঠিত হয়ে ক্রন্দন করেছ, তাই প্রজাসমূহ তোমাকে রুদ্র নামে অভিহিত করবে।” এই রুদ্রশিবই ব্রহ্মাণ্ডের কৈলাশে তমগুণাচ্ছন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা পূজিত হন এবং কল্পান্তে তিনি ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস করেন। শাস্ত্রানুসারে, কল্পভেদে রুদ্র কখনো ব্রহ্মার ভ্রূ-যুগল-মধ্য থেকে, কখনো বিষ্ণুর ললাট থেকে প্রকাশিত হন। কল্পাবসানে সংকর্ষণ থেকেও কালগ্নি রুদ্রের জন্ম হয়।

উল্লেখ্য, সৃষ্টিপ্রক্রিয়া এবং শিবের উৎপত্তি প্রসঙ্গে পুরাণশাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। এর অন্যতম কারণ হলো কল্পভেদ। ব্রহ্মার একদিনকে বলা হয় এককল্প (৮৬৪ কোটি বছর)। কল্পান্তে প্রলয়কালে চতুর্দশ ভুবনের উপরের তিনটি লোক ব্যতীত সমস্ত লোকই ধ্বংস হয় এবং পরবর্তী কল্পে পুনরায় তা সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মার আয়ুষ্কাল শেষ হলে পুরো ব্রহ্মাণ্ডটিই ধ্বংস হয়ে যায়। পুরাণসমূহ ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, যেখানে যুগযুগ ধরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন কল্পের ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। আমরা প্রতিদিনের একই কার্যক্রম একইভাবে সম্পাদন করি না। যেমন— আমরা প্রতিদিনই আহার করি, কিন্তু একই খাদ্য বা একইভাবে নয়; কোনোদিন হাত দিয়ে, কোনোদিন চামচ দিয়ে; প্রতিদিনই অফিসে যাই, কোনোদিন সামনের সিটে বসে, কোনোদিন পেছনের সিটে, কোনোদিন গাড়িতে, কোনোদিন রিকশায়। তেমনি একই সৃষ্টিকার্য কল্পভেদে ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্পন্ন হতে পারে। সুতরাং এ নিয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে বরং সেই ঘটনার মূল শিক্ষাগুলোই আমাদের গ্রহণ করা উচিত।

পরিশেষে, অচ্যুত ভগবান শ্রীকৃষ্ণই সমস্ত অবতারের মূল— কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্— তিনিই স্বয়ং ভগবান। মূলে জলসেচন করলে পত্রপুষ্পাদির সন্তোষ আপনা থেকেই সাধিত হয়ে থাকে। তাই গুণাবতার শিব, সদাশিব ও স্বয়ং ভগবানের তত্ত্ব অবগত হয়ে শুদ্ধভক্তগণ তাঁদের যথাযোগ্য পূজা করে থাকেন। —হরেকৃষ্ণ

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *