ব্যর্থ ভালোবাসা

দেবামৃত স্বামী

………………………………………………………………………..

প্রতিটি জীবের যে ভালোবাসার প্রবৃত্তি রয়েছে তার মূলে রয়েছে বিকৃত ভালোবাসার আনন্দ উপভোগের এক প্রবল ইচ্ছা। এমন নয় যে, এই ইচ্ছাটি হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, বরং ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সভ্যতায় এই ভালোবাসার ইচ্ছাটিকে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এখন ঐতিহ্য বিনষ্টের সাথে সাথে কাউকে ভালোবাসার এবং কারো থেকে ভালোবাসা পাওয়ার এই তীব্র কামনা অনিয়ন্ত্রিত, পাশবিক এবং শৃঙ্খলাবিহীন আবেগপূর্ণ উপভোগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যগত নীতি-নিয়ম থাকুক বা না-ই থাকুক, প্রত্যেক জীবের মধ্যেই এ ভালোবাসার প্রবৃত্তি নিত্যকাল ধরে বর্তমান। সুদক্ষতার সাথে নিজের জীবনধারা বিবেচনা করলে আপনি ভাববেন, “কীভাবে আমি এই ভালোবাসার প্রবৃত্তিটি ব্যবহার করব? আমি কি ঐতিহ্যগত পন্থা অনুসরণ করব, নাকি বর্তমান ধারায় এগিয়ে যাব।” যে পন্থাই করি না কেন, একটি বিষয় আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, পুরুষ বা নারী, যুবক বা বৃদ্ধ- জীব মাত্রেরই ভালোবাসার প্রবৃত্তির তৃপ্তি সাধনের পিপাসা রয়েছে। এটা ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন ধরনের রূপ ধারণ করতে পারে। যেমন, পারিবারিক, প্রণয়মূলক, বন্ধুত্বসুলভ এবং আরো অনেক ধরনের সম্পর্কের মতো। কিন্তু সবকিছুর মূল হচ্ছে একটিই, প্রেম বিনিময়ের মৌলিক ইচ্ছা।

   পরবর্তীতে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন আমাদের মধ্যে এই ইচ্ছাটি রয়েছে? কারণ আমরা শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অংশ “জন্মাদ্যস্য যতোহন্ব্যাদিতরতশ্চার্থেষ¦াভিজ্ঞঃ স্বরাট্”। শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম শ্লোকে স্বীকার করা হয়েছে যে, সবকিছুর পরম সত্য হচ্ছেন তিনি, যার থেকে সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয়। যেহেতু কৃষ্ণের মধ্যে ভালোবাসার গুণ রয়েছে, তাই আপনার মধ্যেও তা বিদ্যমান। পরম সত্যের এই ব্যক্তিগত সম্পর্ককে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্ক এবং আমাদের সম্পর্কের মধ্যে পাথর্ক্য এই যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কে সর্বদা সম্পূর্ণরূপে সফল এবং পরিতৃপ্ত। অন্যদিকে, এ জগতের সমস্ত ব্যক্তি সম্পর্কের সাথে কালের আবর্তনে সর্বদা যুক্ত থাকে হতাশা এবং অতৃপ্তি। কাল সবকিছুকে ধ্বংস করে, ঠিক যেমন গতকাল যা সতেজ ছিল, আজ তা নিস্তেজ। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের স্বীয় ধাম, চিন্ময় জগৎ সম্পূর্ণরূপে কালের প্রভাব থেকে মুক্ত। কিন্তু এ জগতের সমস্ত ব্যক্তিগত বা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, স্থান-কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ হওয়ার দরুন সর্বদা সমস্যাসংকুল। হৃদয়ে যে বিষয়ের অনুসন্ধান আপনি করছেন তা হলো নিষ্কলুষ প্রেমের সম্পর্ক। তার মানে আপনার শ্রীকৃষ্ণ লাভের তীব্র লালসা রয়েছে। শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণই পারে আপনাকে পরিপূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত করতে। ভক্তিযোগ হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থায় ভালোবাসার শিল্প, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি। জাগতিক জীবনে, জীবনযাপনের এমন কোনো পন্থা নেই যা আমাদের নিজেদের বা অন্যদের পরিতৃপ্ত করতে পারে। আমাদের ভালোবাসা এবং অন্যদের কাছ থেকে ভালোবাসা প্রাপ্তির প্রত্যাশাই হতাশারূপে আমাদের হৃদয়কে দগ্ধীভূত করে। তাই এর দ্বারা কখনোই সম্পূর্ণরূপে পরিতৃপ্তি লাভ করা যায় না। ঠিক যেভাবে শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিরসামৃত সিন্ধুর প্রারম্ভে বর্ণনা করছেন, “শুধু কৃষ্ণকে ভালোবাসার মাধ্যমে কীভাবে প্রত্যেককে যথাযথভাবে ভালোবাসা যায়, সেই কৌশলই হলো কৃষ্ণভাবনামৃত।”

ভালোবাসাকে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে দর্শন

ভেবে দেখুন, বর্তমানকালে এ জগতের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসা কি আদৌ সম্ভব? কোনো ব্যক্তি বিশেষ বা গোষ্ঠীর প্রতি আপনার ভালোবাসা কতটুকু ফলপ্রসূ? একটা নির্দিষ্ট সময়ে প্রকৃতপক্ষে আপনি কতজন জীবকে ভালোবাসতে পারবেন? নিজের কাছে সৎ হলে আপনি দেখবেন যে, এমনকি একজন ব্যক্তিকেও ভালোবাসতে এবং ভালোবাসার চেষ্টা করতে হলেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বস্তুত ঐ লোকটির জন্য আপনি কী করতে পারেন?

   ছোট শিশু থাকাকালীন আপনি আপনার মাকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন, কারণ তিনি আপনার যত্ন নিতেন। একটু বড় হলে আপনি ধীরে ধীরে আপনার বাবা, ভাইবোনদের ভালোবাসতে লাগলেন। তরুণ অবস্থা প্রাপ্ত হলে, আপনি আপনার ক্রিকেট টিম বা অন্য কোনো খেলাকে ভালোবাসতে লাগলেন। আরো বেশি শিক্ষা লাভ করে আপনি আপনার শহর বা জাতিকে ভালোবাসতে শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আপনার মধ্যে সমগ্র মানবসভ্যতাকে ভালোবাসার একটি ধারণা উদ্ভূত হলো। আমি জানি না ভারতে এটি হয় কি না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের লোকেরা বিলুপ্তপ্রায় তিমি এবং পাখিদের প্রজাতিসমূহের রক্ষার্থে অনুদান করে খুব গর্বিত হয়। যদিও তারা একই সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার গাভীকে জবাই করছে। কিন্তু গর্বে স্ফীত হয়ে তারা বলে, “দেখ! আমি কীভাবে ডলফিন এবং নীল পাখিগুলোকে সুরক্ষা দান করছি।” সুতরাং, এটি হচ্ছে সেই একই ভালোবাসার বৃত্তির একটি ব্যর্থ রূপ। যেকোনো জীব এমনকি আপনার পোষা কুকুরটির প্রতিও আপনি ভালোবাসা অনুভব করতে চান। নিশ্চয়ই এমন কেউ আছে যাকে আপনি ভালোবাসতে চান। ভালোবাসার নীতি বিনিময়ের কার্যক্রমটি বিশ্লেষণ করলে আপনি দেখবেন যে, এটি কখনোই আপনাকে আত্মতৃপ্ত করতে পারে না। এই অপূর্ণতা ঢাকার জন্য হয়ত আপনি নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখেন অথবা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এই দুটির মধ্যে আপনি যেকোনো একটি অথবা উভয়টিকে বেছে নিতে পারেন। আপনি একইসাথে কাজের চাপে ব্যস্ত এবং নেশায় বিভোর হয়ে থাকতে পারেন। এভাবে আপনি অতৃপ্ত ভালোবাসার এই বাস্তবতাকে ধামাচাপা দিয়ে শঠতাপূর্ণ কলিযুগের গভীর থেকে গভীরে নিমজ্জিত থাকতে পারেন।

   ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করছেন যে, জীব প্রথমে ইন্দ্রিয়তৃপ্তির কথা মনে মনে চিন্তা করে, তারপর ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনামূলক কার্যে লিপ্ত হয় এবং তারপর সে হতাশাগ্রস্ত এবং ক্রোধান্বিত হয়। কারণ, ইন্দ্রিয়তৃপ্তিতে প্রকৃত সন্তুষ্টি নেই। সুতরাং, আপনি তখন রজোগুণের স্তর থেকে ক্রোধের তমোগুণে অধঃপতিত হোন। আপনাদের মধ্যে অনেকেই পেশাজীবী অথবা পেশাজীবী হওয়ার জন্য লেখাপড়া করছেন। তাই আপনারা নিশ্চয়ই জানতে আগ্রহী যে, ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎটা কেমন হবে? ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের জন্য এক চরম দুর্দিন অপেক্ষা করছে, যদি আমরা জনগণকে এই কালজয়ী জীবনধারা ভক্তিযোগের শিক্ষা না দিই।

ধার করা সমাধান ফলপ্রসূ নয়

আমি নিশ্চিত, আপনি যদি আপনার মাতা-পিতাকে বলেন যে, আপনি লন্ডনে একটি চাকরি পেয়েছেন। তবে তারা খুব গর্বিত হয়ে বলবে, “দেখ! আমার ছেলে এখন লন্ডনে চাকরি করে।” লন্ডনের অফিস জীবনটা আসলে কেমন তার কিছু পরিসংখ্যান নি¤েœ উপস্থাপন করছি। এটি হচ্ছে লন্ডনের অফিস-জীবনের ওপর একটি জরিপের চূড়ান্ত ফলাফল, যা ‘উধরষু ঞবষবমৎধঢ়য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে আপনি দেখবেন, ভালোবাসার এই প্রবৃত্তির সঠিক ব্যবহার সম্বন্ধে অজ্ঞাত মানুষগুলোর জীবনটা আসলে কেমন এবং নিজেকে আত্মতৃপ্ত করতে গিয়ে তারা কীভাবে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা যে সুখের সন্ধান করছে, তা আসলে বিকৃত সুখ। আপনি শুনে ব্যথিত হবেন যে, কীভাবে শহুরে পেশাজীবীরা তাদের জীবনে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার জন্য জঘন্য কার্যে লিপ্ত হচ্ছে।

   ৪৫% পেশাজীবী নিজেদের পদোন্নতির জন্য সহকর্মীর বিভিন্ন ক্ষতিসাধন করে।

   ১৩% স্বীকার করে যে, পদোন্নতির জন্য তারা বসের সাথে রাত কাটায়।

   ৩৬% স্বীকার করে যে, তারা তাদের জীবনবৃত্তান্তে ভুল তথ্য দিয়েছে।

   ৫০% পেশাজীবী অফিস চলাকালীন সময়ে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে থাকে।

   ৬৩% স্বীকার করে যে, তারা অফিস প্রাঙ্গণে মাদকদ্রব্য বিনিময় করে থাকে।

   ৬২% অফিসগামী লোক সহকর্মী দ্বারা যৌন প্রস্তাব পায়।

   ২০% পেশাজীবী অফিসে যৌনকার্যে লিপ্ত হয়।

   ৩৩% পেশাজীবী ইন্টারনেটে নগ্নচিত্র দেখে।

   ২৮% পেশাজীবী তাদের খরচকে বেশি করে দেখায়।

   ৪২% পেশাজীবী কার্যক্ষেত্রে অনেক কিছু চুরি করে।

এগুলো হচ্ছে লন্ডনের উচ্চ শ্রেণির পেশাজীবী কর্তৃক সংঘটিত কার্যক্রমের কিছু অংশ।

এছাড়াও আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ইংল্যান্ডে-

   বিবাহের মাধ্যমে সন্তান ধারণের চেয়ে বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানের সংখ্যা বেশি।

   বিবাহ অনুপাত সর্বকালের সর্বনিম্ন মাত্রায় পৌঁছেছে।

   এটি এখন ইউরোপের বিবাহ বিচ্ছেদের রাজধানী।

   সন্তানপ্রসবা তরুণীদের ৯০ ভাগই অবিবাহিত।

   শুদ্ধ সংস্কৃতিবর্জিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং শৃঙ্খলাবিহীন মানুষের এমনটিই ঘটে থাকে। লন্ডনে, নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলস অথবা সিডনিতে যদি আপনি যান এবং ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পন্থায় একজন সভ্য মানুষের মতো আচরণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পূরণ করতে চান, তবে মানুষ আপনাকে উপহাস করে বলবে, “এসব কর্তব্যের বোঝা কেন মাথায় নিচ্ছ? তোমার বর্তমান বাসনাকে চরিতার্থ কর। হয়তবা গতকাল তুমি কাউকে বিয়ে করেছিলে, কিন্তু আজকের দিনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই এসব ভুলে যাও।” এখন যদি তাদের কথার যথাযথ প্রত্যুত্তর আপনি দিতে না জানেন, তবে আপনি নিশ্চিতভাবে মোহিত হয়ে যাবেন এবং এটিই হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় যুবকদের প্রধান সমস্যা। তারা শুধু সামাজিক চাপে পড়ে ঐতিহ্যগত পন্থায় আচরণ করে। তারা এর মূল কারণটি অনুধাবন করতে পারে না। এসব কারণ বা যুক্তিসমূহ না জানলে, আমরা নিজেদের জীবনে এগুলো প্রয়োগ করতে পারব না এবং এই ঐতিহ্যের পেছনে যুক্তিসমূহ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিশ্লেষণ করতে পারব না। সর্বেচ্চ যে যুক্তিটা দেখা যায়, “আমাদের পরিবার এভাবে এই ঐতিহ্যটি পালন করে আসছে, তাই আমাদের উচিত একে অনুসরণ করা।”

   এভাবে, ভারতীয় যুবকেরা এখন উভয় সংকটে। তারা না পারছে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে সরল জীবনযাপন করতে, কারণ, এটি খুব কঠিন; অন্যদিকে না পারছে অনিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ে বাঁচতে। এ অবস্থায় কী করা কর্তব্য? শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে ব্যাখ্যা করছেন, যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলছেন, “উচ্চতর আধ্যাত্মিক রস আস্বাদন না করে ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তুমি ভ-ামি ছাড়া আর কিছুই করছ না।” এই দ্বন্দ্বটি নিরসন করা যায় ভক্তিযোগ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহকে ইন্দ্রিয় অধিপতি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত করার মাধ্যমে। এভাবে ইন্দ্রিয়পতির সেবার মাধ্যমে আপনি পরিশুদ্ধ হবেন এবং আপনার হৃদয়ের ভালোবাসাও পরিতৃপ্ত হবে। কেননা, কৃষ্ণ সমস্ত জীবের ভালোবাসার সঠিক প্রতিদান দিতে পারেন।

   এজন্যেই কৃষ্ণতত্ত্ব বিজ্ঞান এত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণের নাম, রূপ, গুণ, যশ এবং লীলা অনুধাবন ব্যতীত কীভাবে আমরা ভবিষ্যতে আমাদের ভালোবাসার প্রবৃত্তিকে পরিতৃপ্ত করার আশা করতে পারি? কোনো স্বতন্ত্র জীব বা কোনো জীবগোষ্ঠী কখনো আমাদের ভালোবাসার ইচ্ছাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। আমাদের ভালোবাসার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কৃষ্ণের সাথে যুক্ত হওয়া, কৃষ্ণই পারেন আমাদের ভালোবাসার যথার্থ প্রতিদান দিতে। তখন প্রতিটি জীবকে স্বতন্ত্রভাবে ভালোবাসার আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না। ঠিক যেমন, অত্যাধুনিক ভবনসমূহে দরজার সামনেই একটি মাস্টার সুইচ থাকে, যা দিয়ে আপনি চাইলে ঘরের সবগুলো লাইট জ্বালাতে পারেন অথবা নিভাতেও পারেন; অথবা যদি আপনার গাড়িতে সেন্ট্রাল লকিং সিস্টেম থাকে, তবে আলাদা-আলাদাভাবে সবগুলো দরজা বন্ধ করার বদলে চালক সেন্ট্রাল লকিং সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় তালাবদ্ধকরণ প্রণালী ব্যবহার করে এটি করবেন। সুতরাং, কৃষ্ণকে ভালোবাসার মাধ্যমে সমস্ত প্রকারের ভালোবাসা পরিতৃপ্ত হবে। এটিই হচ্ছে ভক্তিযোগের বাস্তব রহস্য। কারণ, কৃষ্ণ হচ্ছেন অসীম, সমস্ত শক্তির অধিষ্ঠাতা। তাই, কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার জন্য আপনার সমস্ত প্রচেষ্টার ফল কখনো কমবে না। কাউকে ভালোবাসতে আমাদের ভালোবাসা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং এটিই হচ্ছে সমস্ত হতাশার কারণ। ভালোবাসা সবসময় একই থাকে না। বর্তমানে ভারতবর্ষের অধিবাসীরা শুধু কর্তব্য এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে সংসার জীবন প্রতিপালন করছে, যদিও ভালোবাসার স্বাদ এখন শূন্যের কোটায়।

ভোগবাদকে স্থায়ী করতে বিভিন্ন জল্পনা এবং মিথ্যা যুক্তি

প্রত্যেকেই ভোগ করতে চায়। মাঝে-মাঝে অনেকে বলে থাকে, “আমাদের মধ্যে ভোগপ্রবণতা আছে, কারণ ভগবান আমাদের তা দিয়েছেন।” এই কথার কিছুটা সত্যতা রয়েছে, কারণ আমরা পরম ভোক্তার ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু জড়জগতে এই ভোগের প্রবণতা কৃষ্ণ আমাদের, জড়জগৎ ভোগ করার জন্য দেননি। এটিই হচ্ছে আমাদের সমস্যা। কৃষ্ণ চান আমরা যেন তার সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে উপভোগ করি। কৃষ্ণলীলায় কৃষ্ণ তাকে ভালোবাসার অনেকগুলো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের দেখিয়ে গেছেন। তিনি তার লীলাসমূহ প্রকাশ করেন যাতে করে আমরা আমাদের প্রকৃত স্বরূপে অবস্থান করতে পারি অর্থাৎ তাকে ভালোবাসতে পারি। একবার ভগবানকে পরম প্রেমিকরূপে আবিষ্কার করতে পারলে তৎক্ষণাৎ আমরা জড় বস্তুতে সুখানুসন্ধানের জাগতিক প্রয়াস থেকে মুক্ত হব। ভক্তিযোগ মানে শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসা। এখন প্রশ্ন জাগে, কেন আমি কৃষ্ণকে ভালোবাসব? এই রহস্যটি আমাদের বের করা উচিত। তাই কৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বলেছেন, “জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্। ” ভগবান বলেছেন, তুমি যদি কেবল আমার জন্ম এবং কর্ম তত্ত্বগতভাবে উপলব্ধি করতে পারো, তবে বর্তমান শরীর ত্যাগের পর তোমাকে আর জড় শরীর ধারণ করতে হবে না।

   যে উভয় সংকটে তুমি আছ, তার কথা চিন্তা কর। ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে অথবা ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে, কোনোভাবেই পরম সুখ অর্জন সম্ভব নয়। পরম সুখ অর্জনের জন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে সেবায় নিয়োজিত করতে হবে। ভক্তি মানে নিজের শক্তিসমূহকে কৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত করা, যার ফলে আমাদের ভালোবাসার প্রবৃত্তি সম্পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত হবে। ভক্তেরা একে অন্যকে সহজেই ভালোবাসতে পারে, কারণ তাদের মধ্যকার মাধ্যম হচ্ছে কৃষ্ণ। কৃষ্ণকে মাঝখানে না রেখে কাউকে ভালোবাসা মানেই হচ্ছে অন্ধকার গর্তে লাফ দেয়া। যেখানে কৃষ্ণ রয়েছেন, সেখানে সূর্যও রয়েছেন এবং সূর্যালোকের উপস্থিতিতে আপনি চারপাশের সবকিছুকে তাদের প্রকৃতরূপে দর্শন করতে পারবেন। কিন্তু কৃষ্ণ-সূর্য যদি সেখানে উপস্থিত না থাকে, তবে সেই সম্পর্ক হবে ঠিক অন্ধকারে কিছু খোঁজার মতো, বিশেষ করে যদি সেই সম্পর্কের ভিত্তি হয় চর্ম। আত্মা ও আত্মার সম্পর্ক এবং আত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতার মূলনীতি। (বাকি অংশ ১৩ পৃষ্ঠায়…)

অন্যদিকে চর্মের ভিত্তিতে যে সম্পর্ক, সেটি হচ্ছে একটি দাসত্বের শৃঙ্খল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি তা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবেন, নাকি শুধু শোনার মাধ্যমে উপলব্ধি করবেন?

   সুতরাং, সর্বপ্রথমে নিজের কাছে সৎ হোন। “আমার মধ্যে ভালোবাসার ইচ্ছা আছে।” এখন এই ভালোবাসার ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিটিকে কীভাবে পরিতৃপ্ত করা যায়, তার পরিকল্পনা করুন। ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস- এই চারটি আশ্রম ভালোভাবে অনুধাবন করুন। এই আশ্রম প্রণালীর একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপন করা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মানসিক শান্তি এবং নিয়ন্ত্রিত আচরণের অধিকারী হওয়া যাবে, ফলে যে কেউ জীবনের চরম লক্ষ্য কৃষ্ণপ্রেম অর্জনে নিজের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করতে পারবে।

   কৃপাপূর্বক স্মরণ রাখুন, কৃষ্ণের মধ্যে যেহেতু ভালোবাসার প্রবৃত্তি আছে, তাই তাঁর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশরূপে আমাদের মধ্যেও তা রয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণ নিজেকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজ শক্তির বাইরে কখনোই যান না। তিনি তাঁর হ্লাদিনী শক্তির মাধ্যমে সবকিছু আস্বাদন করেন, যা তাঁর নিত্য প্রেম সঙ্গিনীরূপে আবির্ভূত হন। আমাদের সেই শক্তি নেই, তাই আমরা আমাদের বাইরের কাউকে ভালোবাসার মাধ্যমে সেই ভালোবাসার পরিতৃপ্তি পেতে চাই। আর এ কারণেই এতসব সমস্যার উৎপত্তি। কৃষ্ণ সর্বদাই আত্মতৃপ্ত। তিনি কখনোই কারো ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি আপন শক্তিবলে নিজের সন্তুষ্টি উৎপন্ন করেন। অন্য সমস্ত জীবকে ভালোবাসার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে আমরা নিজে-নিজে কখনো ভালোবাসায় আত্মতৃপ্ত হতে পারি না। শুধু কৃষ্ণকে গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা সমস্ত জীবকে ভালোবাসতে পারি। -হরেকৃষ্ণ।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *