বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভু

নদীয়া প্রকাশ…………………………………………………………..

চতুর্দশ ভূবনাত্মক দেবীধামের (জড়জগতের) উপরিভাগে শ্রীশিব—ধাম। সেই ধাম মহাকাল—ধাম নামে একাংশে অন্ধকারময়। সেই অংশ ভেদ করে মহা আলোকময় সদাশিবলোক। শিবধামে শ্রীমহাদেব কপূর্রের ন্যায় গৌরবর্ণ, ত্রিনয়ন, দিগম্বর, শিরোদেশে দীপ্তিমান অর্ধচন্দ্র অতি সুন্দর পুরুষরূপে বিরাজমান। তাঁর হস্তে ত্রিশূল, মস্তকে জটাবলি, গঙ্গাজলে অম্লান, গাত্রে ভস্মের অঙ্গরাগ, আর তিনি বৈষ্ণবচূড়ামণিগণের অস্থিসমূহে মাল্য নিমার্ণ করে তা কণ্ঠে ধারণ করেছেন। গৌরাঙ্গী শ্রীগৌরী তাঁর অঙ্কশ্রিতা হয়ে তাঁর সেবা করছেন। তিনি বিষয়সম্বন্ধ ত্যাগী ও মুক্তকুল হতেও শ্রেষ্ঠতম হয়ে ছত্রচামরাদি বিষয়ভোগ করছেন। ধর্মপরিপালক পরমেশ্বর হয়েও সদাচার লঙ্ঘন করছেন। এতে তাঁর কোনো দোষ নেই। কারণ, তিনি মুক্তিপদেরও উপরে বিরাজমান, মুক্ত সকলেরও সম্পূজ্য ও বৈষ্ণবগণের বল্লভ। তিনি সর্বদাই নৃত্যগীত, ভগবন্নামসংকীর্তন, প্রেমরোদন প্রভৃতি কৌতুক বিস্তার করে স্বীয় ভক্তগণকে তদভিন্ন স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণে ভক্তি শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি জগতের ঈশ্বর হলেও দাসের ন্যায় নিত্য প্রেমভরে সহস্রমুখ শেষমূর্তি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পূজা করে থাকেন।
শ্রীশিব বা শম্ভুর দুটি রূপ আছে। বৈষ্ণবদর্শনে তিনি জগদ্গুরু— “বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভুঃ”— এই বিচার। বৈষ্ণব দর্শনেই তাঁর শিবত্ত্ব বা শম্ভুত্ব প্রকটিত। সেখানে তিনি মায়াতীত মায়াসঙ্গী নন। তাঁর অন্যরূপ মহাকাল রুদ্র বা সংহার মূর্তি। এর-ই সঙ্গিনী মায়া বা মহাকালী। বৈষ্ণব দর্শনে শ্রীশিবকে বিষ্ণুর প্রিয়তম বা অভেদরূপে জানা যায়। সেখানে তমঃসঙ্গী বা নির্ভেদ বিচার নেই। বৈষ্ণবদর্শনে উমা—মহেশ্বর বৈষ্ণব বৈষ্ণবীÑ পরস্পর হরিভজনের সহায় এবং পরস্পরের মধ্যেও ‘বৈষ্ণব’ বুদ্ধি।
শ্রীবিষ্ণু ও শ্রীশিব— সেব্য-সেবকরূপে অভিন্ন। ‘রামেশ্বর’ শিবের একটি নাম। সংকর্ষণ রাম যাঁর ঈশ্বর, তিনিই রামেশ্বর অর্থাৎ শ্রীশিব। তিনি মঙ্গলময়। যাঁরা উপাসনার নিত্যত্ব স্বীকার করেন, তাঁরা রুদ্রের পক্ষপাতী নন, তাঁরা মঙ্গলময় ও কৃপাময় শ্রীসদাশিবের পক্ষপাতী। শ্রীসদাশিব আমাদের আরাধ্য— গুণাবতার রুদ্র নন। সর্বেশ্বরেশ্বর শ্রীভগবানের প্রকৃতিসম্বন্ধ কোনো কার্য আধিকারিক দেবতারূপে রুদ্র নির্বাহ করেন। সেই রূপের সাথে আমাদের প্রয়োজন নেই, সদা মঙ্গলময়রূপের সাথেই আমাদের সম্বন্ধ। সদাশিব রামনামের উপাসক। শ্রীসদাশিব তাঁর গলদেশে শ্রীশেষদেবকে নিত্যকাল ধারণ করেন। শ্রীগুরুপাদপদ্মকে তিনি নিত্যকাল কণ্ঠে ধারণ করে থাকেন। স্বীয় কীর্তনকারী শ্রীগুরুদেবকে সর্বক্ষণ ধারণ করে তাঁর মহিমাপূর্ণ শ্রীমদ্ভাগবতবাণী শ্রবণ ও কীর্তন করেন। তিনি কত বড় গুরুদেবতাত্মা! সেই গুরুদেবতাত্মার সঙ্গেই আমাদের প্রয়োজন। শ্রীসদাশিব নিত্যকাল মঙ্গলময়। তিনি সত্ত্বরজস্তমোগুণের অতীত। বিরজারূপী গঙ্গাকে— শ্রীবিষ্ণুপাদোদককে মস্তকে ধারণ করে জগন্মঙ্গলময় শ্রীশিব নাম সার্থক করেছেন। শ্রীসদাশিব শ্রীসুরধুনীকে শ্রীবিষ্ণুর প্রসাদ, পাদোদক, তীর্থ বা শ্রীচরণামৃতরূপে মস্তকে ধারণ করেছেন— কণ্ঠে শ্রীঅনন্তরূপী শ্রীগুরুদেবকে রেখেছেন।
শুদ্ধবৈষ্ণবগণ শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়তম-বিচারে শ্রীশিবের উপাসনা করে থাকেন। তাঁরা শ্রীশিবকে পৃথক ঈশ্বর-বুদ্ধিতে তাঁর সেবা করেন না। শ্রীশিব শ্রীবিষ্ণুর প্রিয়তম, তাঁর সেবা করলে শ্রীবিষ্ণু সুখী হন— এই বিচারে ভক্তগণ শ্রীশিবের আরাধনা করে থাকেন।
শ্রীশিব নিজেই নিরুপাধিক শ্রীকৃষ্ণপ্রীতির অবধূত।
শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিতেই তিনি উন্মত্তÑ পাগল। শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিতে উন্মত্ত হয়েই তিনি শ্মশানে-শ্মশানে সর্বত্র বিচরণ করে থাকেন। প্রচেতাগণ যেভাবে শিবের পূজা করেছেন সেরূপ শ্রীশিবপূজাই বিধিসম্মত ও আদর্শ। শাস্ত্র বলেছেন—
শিবো ভবতু বৈষ্ণবঃ কিমজিতোহপি শৈবঃস্বয়ম্
তথা সমতয়াথবা বিধিহরাদিমূত্তির্ত্রয়ম্।
বিলোক্য তৎবেধসোঃ কিমপি ভক্তবর্গক্রমং
প্রশম্য শিরসা হি তৌ বয়মুপেন্দ্রদাস্যং শ্রিতাঃ।
স্তে শ্রীবিষ্ণুপরায়ণাবিধিভব-প্রেষ্ঠা জগন্মঙ্গলাঃ।
যেহন্যে রাবণ-বাণ-পৌণ্ড্রক-বৃক ক্রৌঞ্চাদয়ন্তে স্বয়ং
যদ্ভক্তা ন চ তৎপ্রিয়া ন চ হরেস্তস্মাজ্জগদ্বৈরিণঃ।
শ্রীশিব বিষ্ণুর উপাসক-নিবন্ধন শ্রীবিষ্ণু জগদুপাস্য হোন কিংবা শ্রীবিষ্ণু শিবের উপাসক নিবন্ধন শ্রীশিবই জগস্তুপাস্য হোন অথবা শ্রীব্রহ্মা, শ্রীবিষ্ণু, শ্রীশিব— তিনজনই সমভাবেই জগদুপাস্য হোন, আমরা শ্রীমহাদেব এবং শ্রীব্রহ্মার ভক্তগণের অন্তঃপাত শাস্ত্রে অবলোকনপূর্বক তাঁদের উভয়কে মস্তকের দ্বারা দণ্ডবৎ বিধান করে শ্রীউপেন্দ্রের অর্থাৎ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর দাসত্ব অবলম্বন করেছি। কারণ, শ্রীপ্রহ্লাদ, শ্রীধ্রুব, শ্রীবিভীষণ, শ্রীবলি, শ্রীব্যাস ও শ্রীঅম্বরীষ প্রভৃতি মহাজনগণ বিষ্ণুপরায়ণ, এজন্য তাঁরা শ্রীশম্ভু ও শ্রীব্রহ্মার পরম প্রীতিভাজন ও জগন্মঙ্গল বিধায়ক। আর রাবণ, বাণ, পৌণ্ড্রক, বৃক প্রভৃতি অসুরগণ শ্রীব্রহ্মা এবং শ্রীমহাদেবের ভক্ত অভিমান করেও তাঁদের প্রিয় হতে পারেনি, এজন্য তারা জগতের পরম শত্রু হয়েছিল।
বাণনৃপতি নিজেকে শ্রীমহাদেবের পরম ভক্ত বলে অভিমান করতেন। তিনি মহাদেবের নিকট হতে সহস্র বাহু প্রাপ্ত হয়ে সেই মহাদেবের সাথেই যুদ্ধ করেন। শ্রীমহাদেব বাণনৃপতিকে অভিসম্পাত করছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের সাথে যুদ্ধে বাণনৃপতির সহস্র বাহুর মধ্যে কেবলমাত্র চারটি বাহু থাকে। বাণ জগতের ভীষণ শত্রুতা সাধন করে বিনষ্ট হয়। এ ধরনের মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিজের আরোহ চেষ্টায় শিবের নিকট হতে জোর করে কিছু প্রাকৃত-বল লাভপূর্বক সেই বলের দ্বারা শিবকে হনন ও বিষ্ণু বিদ্বেষ করার জন্য ধাবিত হন। তাঁরা শ্রীশিবের প্রিয় নন, এজন্য তাঁদের উপর শ্রীশিবের চির-অভিসম্পাত রয়েছে। পৌণ্ড্রকও নিজেকে একজন শিবভক্ত বলে অভিমান করতো। সে শিবের নিকট বর প্রাপ্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় এবং তাতে চিরবিনষ্ট হয়। বৃক শ্রীশিবের ভক্তাভিমানী ছিল। অনেক তপস্যা করে এই বৃক শিবের নিকট হতে বর প্রাপ্ত হয় যে, যার মস্তকে সে হস্ত স্থাপন করবে, সেই ব্যক্তিই তন্মূহুর্তেই মৃত্যুগ্রস্থ হবে। বৃক এরূপ বর প্রাপ্ত হয়ে ঐ বরের ফলাফল পরীক্ষা করার জন্য সর্বপ্রথমে বরপ্রদাতা শ্রীশিবকেই নির্বাচনপূর্বক শ্রীশিবের মস্তকে হস্তপ্রদান করতে উদ্যত হলো। শৈব মায়াবাদিগণের বিচারও ঐরূপ। শ্রীশিব উপায়ান্তর না দেখে বৈকুণ্ঠনাথ শ্রীবিষ্ণুর আশ্রয়গ্রহণ করলেন। শ্রীবিষ্ণু ব্রাহ্মণবেশ ধারণপূর্বক বৃককে বললেন— “শ্রীশিবের কথায় বিশ্বাস করো না। তুমি নিজের মাথায় হাত দিয়ে দেখ, কিছুই হবে না।” বৃক শ্রীবিষ্ণুর আদেশানুসারে নিজ মস্তকে হাত দেওয়া মাত্রই বিনষ্ট হলো।
যারা ব্রহ্মারুদ্রাদির নিত্য আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণের সর্বেশ্বরেশ্বরত্ব, সর্বকারণ-কারণত্ব অস্বীকার করে শ্রীব্রহ্মাশিবাদি দেবতার পূজক হন, কিংবা শ্রীশিবের পূজা বা শ্রীব্রহ্মার পূজা করলেই সর্বার্থ সিদ্ধি হবে মনে করেন বা তাঁদেরকেই সর্বেসর্বা মনে করে কেবল স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁদের উপাসনা করে, তাদের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।
পদ্মপুরাণে (উত্তরখণ্ড ৮২.২৯) বলা হয়েছে—
শিবপূজাং প্রকুর্বাণো বিষ্ণুনিন্দাসু তৎপরঃ।
রৌরবেষু নরকেষু বসতে নাত্র সংশয়ঃ।।
“যিনি শিবপূজা করার কথা বলতে গিয়ে বিষ্ণুনিন্দায় তৎপর হন, নিশ্চয়ই তার রৌরব নরকে বাস হয়ে থাকে।” বিপরীতভাবে, বিষ্ণুপূজকও যদি শিবের নিন্দা করেন, তবে তাকেও কঠোর দণ্ড পেতে হয়; প্রজাপতি দক্ষ এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
তাই, বৈষ্ণবগণ এই তত্ত্ব অবগত হয়ে পরম মঙ্গলময় শিবের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি করেন। তারা জানেন পরম বৈষ্ণব শিবের কৃপাকটাক্ষ ব্যতীত ভগবদ্ আরাধনায়ও নিষ্ঠ হওয়া যায় না। যেখানে শিবপূজার উদ্দেশ্য কেবল নিজের ভোগাকাক্সক্ষা চরিতার্থ করা তার দ্বারা কখনো ভগবান শিবকে সন্তুষ্ট করা যায় যায় না। বরং বৈষ্ণবজ্ঞানে ভক্তগণ শিবের প্রতি তাঁদের ঐকান্তিক শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন। ভগবান শিব তাতে অতীব প্রীত হন। শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়ভাজন শিবপূজার ফলে প্রচেতাগণ শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তাই আমরাও পরম বৈষ্ণব শ্রীশিবের চরণকমলে কৃষ্ণভক্তি প্রার্থনা করি। —হরেকৃষ্ণ

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *