দুর্গাপূজা ও কিছু ভ্রান্তধারণা

—– শ্রী পতিত উদ্ধারণ গৌর দাস

  • ভগবান শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক অকালবোধন
  • দেবীভাগবতের প্রামাণিকতা
  • গোপীদের দুর্গাপূজা
  • অর্জুনের দুর্গাস্তব
  • দুর্গাপূজা ও কৃষ্ণপূজা কি অভিন্ন?
  • শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক অকালবোধন কি মূল রামায়ণে আছে?

শরৎকালের দুর্গাপূজা অকালপূজা বা অকালবোধন বলে খ্যাত। কারণ, দুর্গাপূজা বা বোধনের প্রকৃত সময় চৈত্র মাস। দেবীর সে সময়কার পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কল্পনাপ্রবণ কিছু লোক প্রচার করে যে, শরৎকাল যুদ্ধজয়ের পক্ষে উপযুক্ত সময় বলে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের জন্য এই অসময়ে দুর্গাদেবীর বোধন করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের ইতিহাস শ্রীরামচরিত্রের পরম প্রামাণিক গ্রন্থ বাল্মীকিকৃত মূল রামায়ণে নেই। কিংবা রামায়ণের অন্যান্য সংস্করণ যেমন তুলসীদাসের রামচরিতমানস, দক্ষিণ ভারতের তামিল ভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষায় কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমিয়া ভাষায় কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষায় ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষায় পুথি রামায়ণ প্রভৃতি কোথাও নেই। অপ্রামাণিক ও আধুনিক কল্পিত দেবীভাগবত ও শাক্ত কীর্ত্তিবাসের স্বকপোলকল্পিত প্রচলিত রামায়ণের ইতিহাস কেবল বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই প্রচলিত। তবে, আধুনিককালে এ পূজা এখন বিশ্বের বাঙালি অধ্যূষিত অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে।

দেবীভাগবত কি প্রামাণিক গ্রন্থ?

কতিপয় অপসিদ্ধান্তপর স্মার্তদের মতে শ্রীমদ্ভাগবতেরও পূর্বে দেবী ভাগবত রচিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেবী ভাগবত আধুনিক পুঁথি। শ্রীমদ্ভাগবতের সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য শ্রীমদ্ভাগবতেরই অবৈধ অনুকরণে রচিত। শ্রীমদ্ভাগবত অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের বিরচিত। শ্রীধর স্বামীর আবির্ভাবের কিছু পূর্বেই কোনো মৎসর স্মার্তদের দ্বারা রচিত ‘দেবী ভাগবত’ বলে একটি পুঁথিকে অষ্টাদশ পুরাণের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সাত্ত্বত পুরাণগণ এরকম কাল্পনিক নবীন পুঁথিকে ‘পুরাণ’ বলে স্বীকার করেননি।

   অনেকে বলেন, মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ যেহেতু দেবী ভাগবতের টীকা রচনা করেছেন, তখন নিশ্চয়ই দেবী ভাগবত সুপ্রাচীন, এমনকি শ্রীমদ্ভাগবতেরও পূর্বের। কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতের টীকাকার শ্রীধর স্বামীপাদ নীলকণ্ঠ অপেক্ষা অনেক প্রাচীন। মহাভারতের টীকায় গীতা ব্যাখ্যা প্রারম্ভে নীলকণ্ঠ শ্রীধর স্বামীকে গুরুজ্ঞানে প্রণাম করেছেন- 

প্রণম্য ভগবৎপাদান্ শ্রীধরাদীংশ্চ স˜গুরান।

সম্প্রদায়ানুসারেন গীতাব্যাখ্যাংসমারম্ভে ॥

আর মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ ও আধুনিক দেবী ভাগবতের টীকাকার নীলকণ্ঠ উভয়েই একব্যক্তি নন। সম্পূর্ণ পৃথক। মহাভাতের টীকাকার নীলকন্ঠ চতুর্দ্ধর বংশ গোবিন্দ সূরির পুত্র, আর দেবী ভাগবতের টীকাকার রঙ্গনাথের পুত্র এবং শৈবোপাসক। ভাবদীপে নীলকণ্ঠ এই রূপ পরিচয় পাওয়া যায় “দুতি শ্রীমৎপদবাক্য প্রমাণ মর্যাদাধুরন্ধর চতুর্দ্ধর বংশাবতংস-গোবিন্দসূরি সূন্যে নীলকণ্ঠস্য কৃতো ভারত ভাবদীপে। কিন্তু দেবী ভাগবতের টীকাকার তার যে পরিচয় প্রদান করেছেন তা অন্যরূপ-

শ্রীমল্লক্ষ¥বতীং লক্ষ্মীংমাতরং দেশিকোত্তমাম।

পিতরং রঙ্গনাথায্যং দেশিকোত্তমমাশ্রয়ে ॥

রত্নজীপ্রেরিতেনৈব পুরাণান্যবলোক্য চ।

শৈবোপনামকেনৈব নীলকণ্ঠেন কেনচিৎ ॥

বহু সুপ্রাচীন আচার্য ও সর্ব সম্প্রদায়ের আচার্য এবং প-িত শ্রীমদ্ভাগবতের শতাধিক টীকা রচনা করেছেন, কিন্তু কেবল আধুনিক শৈবোপাসক নীলকন্ঠের দেবী ভাগবত টীকা ব্যতীত অন্য কোনো টীকার নামও শোনা যায় না। পরন্তু দেবী ভাগবতের টীকাকার লিখেছেন- দেবীভাগবতস্যাস্য ব্যাখ্যানরহিতস্য চ। ব্যাখ্যানং ক্রিয়তে সম্যক্ তিলকায্যং মহত্তরম্ ॥

   দেবী ভাগবতের আর দ্বিতীয় টীকা না থাকায় তিলক নাম্নী ব্যাখ্যা রচনা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, দেবীভাগবতেও ভাগবতের ন্যায় বহু উক্তি দেখা যায়। কিন্তু দেবীভাগবতে যষ্ঠী, মনসা, মঙ্গলচ-ী পূজার কথা রয়েছে। অষ্টাদশ পুরাণে কোথাও তো এরূপ লৌকিক দেবীগণের উপাসনার কথা নেই। সুতরাং, এটি কখনো বেদসার হতে পারে না। বেদান্তে ‘উৎপত্ত্যসম্ভবাৎ’ (২/২/৪২) অধিকরণে এরকম শাক্ত মতবাদ খ-িত হয়েছে।

 দেবীভাগবত কিছুকাল পূর্বে বঙ্গদেশে প্রথম মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়েছে। তারপর মুম্বাই ভেঙ্কটেশ্বর প্রেসে ছাপানো হয়। এজন্য উক্ত প্রেসের প্রকাশক লিখেছেন যে, পুস্তকান্তরের অভাবে তিনি দেবীভাগবতের পাঠ সংশোধন করতে পারেননি।

   আবার কেউ কেউ বলেন, শংকরাচার্য তো শ্রীমদ্ভাগবতের ভাষ্য রচনা বা এর থেকে কোনো প্রমাণ উদ্ধার করেননি। তবে নিশ্চিত, এটি শংকরাচার্যের পরে রচিত হয়েছে। কিন্তু দেখুন, শঙ্করাচার্য ভগবানের যে আদেশ মান্য করতে এরূপে এসেছিলেন, বেদান্তের অকৃত্রিম ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবতের প্রমাণ উদ্ধার করলে তা কীভাবে সিদ্ধ হবে। তাছাড়া তিনি তো দেবী ভাগবতের টীকা বা কোনো প্রমাণ উদ্ধার করেননি। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ শ্রীমদ্ভাগবতের অনেক প্রমাণ উদ্ধার করেছেন। কিন্তু তিনিও তো দেবীভাগবতের কোনো শ্লোক উদ্ধৃত করেননি।

সুতরাং ভাগবত বলতে শ্রীমদ্ভাগবতই বোঝায়। ঠিক যেমন ভগবান বলতে শ্রীহরিকেই বোঝায়; চন্দ্র, সূর্য, গণেশ নয়। দেবী ভাগবত প্রণয়ন ও প্রচারের চেষ্টা হিংসাত্মক প্রবৃত্তির নামান্তর মাত্র।

ব্রজগোপীকাগণ কেন দুর্গাপূজা করেছিলেন?

শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের দ্বাবিংশতি অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার আশায় গোপীদের কাত্যায়নী ব্রতের উল্লেখ রয়েছে।

শ্রীশুক উবাচ

হেমন্তে প্রথমে মাসি নন্দব্রজকুমারিকাঃ।

চেরুর্হবিষ্যং ভুঞ্জানাঃ কাত্যায়ন্যর্চনব্রতম্ ॥১॥

আপ্লুত্যাম্ভসি কালিন্দা জলান্তে চোদিতেহরুণে।

কৃত্বা প্রতিকৃতিং দেবীমানর্চুনৃর্প সৈকতীম্ ॥২॥

গন্ধৈর্মাল্যৈঃ সুরবিভির্বলিভির্ধূপদীপকৈঃ।

উচ্চাবচৈশ্চোপহারৈঃ প্রবালফত-ুলৈৎ ॥ ৩॥

কাত্যায়নি মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরি।

নন্দগোপসুতং দেবি পতিং মে কুরু তে নমঃ

ইতি মন্ত্রং জপন্ত্যস্তাঃ পূজাং চক্রুঃ কুমারিকাঃ॥৪॥

শুকদেব গোস্বামী বললেন, হেমন্তকালের প্রথম মাসে গোকুলের কুমারী কন্যাগণ দেবী কাত্যায়নীর অর্চনাব্রত পালন করলেন। সারা মাস তারা কেবল হবিষ্যান্ন ভোজন করেছিলেন। হে রাজন, সূর্যোদয়কালে যমুনার জলে ¯œান করে, গোপীগণ নদীর তীরে দেবী দুর্গার একটি মৃত্তিকাময়ী প্রতিমা নির্মাণ করলেন। তারপর তাঁরা ঘঁষা চন্দনের মতো সুগন্ধযুক্ত দ্রব্য এবং সেই সঙ্গে দীপ, ফল, সুপারী, নব পল্লব, সুগন্ধ মাল্য ও ধূপসহ নানা প্রকার উপহারের দ্বারা তাঁর পূজা করেছিলেন।

   “হে দেবী কাত্যায়নী, হে ভগবানের মহাশক্তি, হে মহা যোগশক্তিধারিণী এবং শক্তিশালিনী সর্বনিয়ন্তা, অনুগ্রহ করে নন্দ মহারাজের পুত্রকে আমার পতি করে দিন। আমি আপনাকে আমার প্রণাম নিবেদন করি।” এই মন্ত্র জপ করতে করতে কুমারী কন্যাগণ প্রত্যেকে তাঁর পূজা করছিলেন।

   এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, এই শ্লোকে উল্লিখিত দেবী দুর্গা বহিরঙ্গা শক্তি মহামায়া নন, বরং যোগমায়ারূপে পরিচিত ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি। অনেকে মনে করেন ‘মহামায়া’ ও ‘দুর্গা’ শব্দে বহিরঙ্গা শক্তিকেই উল্লেখ করা হয়, কিন্তু বস্তুতপক্ষে তা সত্য নয়। বৃন্দাবনে গোপীগণ সেই অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়াকেই আরাধনা করেছিলেন।

   আর যদি কেউ বলে যে, গোপীগণ বহিরঙ্গা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। তাতেই বা ক্ষতি কীসে? গোপীদের কী উদ্দেশ্য ছিল তা আমাদের বুঝতে হবে। সাধারণত মানুষ দুর্গাপূজা করে কোনো জাগতিক লাভের আশায়। কিন্তু গোপীগণ এখানে কৃষ্ণকে লাভ করার আশায় দুর্গাপূজা করেছিলেন। কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁরা যেকোনো উপায় অবলম্বনে প্রস্তুত ছিলেন। সেটিই ছিল গোপীদের অত্যুৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য। শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভের আশায় তাঁরা পুরো একমাস যাবৎ দুর্গাপূজা করেছিলেন। আমরা যদি মুর্খের মতো তাঁদের কার‌্যাবলিকে কোনোভাবে জাগতিক মনে করি, তবে কৃষ্ণভাবনামৃত হৃদয়ঙ্গম করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।

অর্জুন কর্তৃক দুর্গাস্তবের কী কারণ ছিল?

মহাভারতে ভীষ্মপর্বের ২৩ অধ্যায়ে সঞ্জয় রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “হে রাজন, শ্রীবাসুদেব দুর্যোধনের সৈন্যদের যুদ্ধ উদ্যত দেখে অর্জুনের কল্যাণ কামনায় বললেন, ‘হে মহাবাহু অর্জুন, শক্রদের পরাজয়ের নিমিত্ত পবিত্র ও সংগ্রাম অভিমুখ হয়ে দুর্গার স্তব কর।”

অর্জুন তখন শ্রীবাসুদেবের বাক্য অনুসারে রথ থেকে নেমে কৃতাঞ্জলিপুটে দুর্গা স্তোত্র আরম্ভ করলেন- “হে কৃষ্ণপিঙ্গলে, কাত্যায়নী, শিখিপুচ্ছধ্বজ ধরে, হে গোপেন্দ্রানুজে, নন্দগোপকুলোদ্ভবে, হে পীতবাসীনি, হে কৃষ্ণে, হে কৈটভনাশিনি, আপনাকে প্রণাম। হে ভগবতি দুর্গে, আপনি স্বাহা, স্বধা, কলা, কাষ্ঠা, সরস্বতী, সাবিত্রী বেদমাতা ও বেদান্ত। আমি বিশুদ্ধ অন্তরে আপনাকে স্তব করছি। আপনার কৃপায় এই মহারণক্ষেত্রে যেন জয়লাভ করতে সমর্থ হই। আপনি ভক্তদের রক্ষার নিমিত্ত দুর্গম পথে, ভয়স্থানে, দুর্গম স্থানে, পাতালে নিত্য বাস করে থাকেন, আর যুদ্ধে দানবদের পরাজিত করে থাকেন। আপনি জৃম্ভনী, মোহিনী, মায়া, হ্রী, শ্রী, সন্ধ্যা প্রভাতী, সাবিত্রী, জননী, তুষ্টি, পুষ্টি, ধৃতি, চন্দ্রসূর্যবিবর্ধিনী, দীপ্তি ও সম্পন্নদের সম্পত্তি। সিদ্ধচারণগণ যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাকে দর্শন করে থাকেন।”

 হে রাজন, অর্জুনের ভক্তি দেখে ভগবতী দুর্গা অন্তরীক্ষে দর্শন দিয়ে বললেন-

স্বল্পনৈব তু কালেন শত্রুন্ জেষ্যসি পাণ্ডব।

নরস্তমসি দুর্দ্ধর্ষ! নারায়ণসহায়বান্।

অজেয়স্ত্বং রণেহরীণামপি বজ্রভূতঃ স্বয়ম্ ॥

(মহাভারত ভীষ্মপর্ব ২৩.১৮)

“হে বীর পা-ব, তুমি অল্পকাল মধ্যেই শত্রুদের পরাজিত করবে। কারণ, স্বয়ং নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ তোমার সঙ্গেই রয়েছেন। অতএব, অন্য শক্রর কী কথা! স্বয়ং বজ্রধারী ইন্দ্রও তোমাকে পরাজিত করতে সমর্থ হবে না।”

একথা বলে দেবী দুর্গা অন্তর্হিত হলেন। পা-ুপুত্র অর্জুন বর পেয়ে জয়লাভে কৃতনিশ্চয় হয়ে রথে আরোহণ করলেন। তারপর কৃষ্ণের শঙ্খধ্বনির সঙ্গে নিজের শঙ্খ ধ্বনিত করতে লাগলেন।

   সঞ্জয় বললেন, “হে রাজন, আমি শ্রীব্যাসদেবের কৃপা প্রভাবে জেনেছি, এই অর্জুন ও কৃষ্ণ পূর্বযুগে নর-নারায়ণরূপে ধরাতলে প্রকাশিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুষ্টচিত্ত ক্রোধের বশবর্তী আপনার পুত্ররা মোহবশত তাঁদের জানে না। হে রাজন, ব্যাসদেব, নারদ মুনি, কণ¦ মুনি, শ্রীপরশুরাম আপনার পুত্র দুর্যোধনকে অর্জুন ও কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আপনার কোপন-স¦ভাব দুরাত্মা পুত্ররা কালপাশে বদ্ধ হয়ে মোহগ্রস্ত হয়েছে, তাই তাঁদের সময়োচিত নির্দেশ তারা গ্রহণ করেনি। আমি পরিষ্কার দর্শন করছি যে, যেখানে ন্যায়, তেজ, কোমলতা, লজ্জা, বুদ্ধি ও ধর্ম থাকে, সেখানেই কৃষ্ণ থাকেন; যে স্থানে কৃষ্ণ, সেই স্থানেই জয়- যতো ধর্মস্ততঃ কৃষ্ণ যতো কৃষ্ণস্ততো জয়।”

এখানে অর্জুনকে দুর্গা নিজেও বলছেন- যেহেতু, স্বয়ং নারায়ণ তথা শ্রীকৃষ্ণ বিদ্যমান (নারায়ণসহায়বান্), সুতরাং অর্জুনের জয় সুনিশ্চিত। কিন্তু শাক্তরা কৌশলে এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাও সর্বশেষ শ্লোকে (১৮.৭৮) বলা হয়েছে-

যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।

তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম ॥

অর্থাৎ, “যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে।  সেটিই আমার অভিমত।”

সুতরাং, বিজয়ের জন্য অর্জুন কর্তৃক দুর্গাস্তবের কোনো আবশ্যকতা বা বাধ্যবাধকতা ছিল না। তাছাড়া, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জয়-পরাজয়ের তথা কর্মফলের আশা ত্যাগ করে কর্তব্যবোধে ও তাঁর (কৃষ্ণের) সন্তুষ্টিবিধানের জন্য যুদ্ধ করতে বলেছেন। তবুও শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তা করতে বলেছেন।

প্রশ্ন হলো, ভগবান তো স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে পারতেন, আমার স্তুতি করো। তা না বলে ভগবান কেন অর্জুনকে দুর্গাস্তুতি করতে বললেন?

“আমার স্তুতি করো”, “আমার শরণাগত হও” – এ ধরনের কথা গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বহুবার বলেছেন। যেমন, মন্মনা ভব মদ্ভক্ত মদ্যাজী মাং নমস্কুরু। অর্থাৎ “তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত করো, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা করো এবং আমাকে নমস্কার করো।” তবুও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাধীন দুর্গাদেবী যেহেতু এ জড়জগৎরূপী দুর্গের অধিকর্ত্রী, পরম বৈষ্ণবী এবং সেই সাথে অসুরনাশিনী, তাই মহাভারতের যুদ্ধের মতো এমন মহৎ কর্মযজ্ঞে দুর্যোধনাদি কৌরবদের মতো অসুরদের বিনাশের পূর্বে, জড়জগৎরূপী দুর্গের)অধিকর্ত্রী হিসেবে দুর্গাদেবীকে মর্যাদা দান এবং পরম বৈষ্ণবী হিসেবে অর্জুন যেন তাঁর আশীর্বাদ লাভ করতে পারে, সেজন্যই অর্জুনকে তিনি দুর্গাদেবীর স্তুতি করতে বলেছিলেন। এখানেও প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এখানে উল্লিখিত দেবী দুর্গা ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি মহামায়া নন, বরং যোগমায়ারূপে পরিচিত ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি, যিনি নন্দপত্মী যশোদার কন্যা (গোপেন্দ্রানুজে, নন্দগোপকুলোদ্ভবে) তথা শ্রীকৃষ্ণের ভগিনীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

তাছাড়া, কারো স্তবস্তুতি করার অর্থ এই নয় যে, তিনিই তার আরাধ্য। ভগবানের ভক্তরাও দেবতাদের শ্রদ্ধা, পূজা নিবেদন বা স্তুতি করেন। তাতে তাদের ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা বা সমর্পণের কমতি হয় না। তাই অর্জুন দুর্গাদেবীর স্তুতি করলেও তা দোষনীয় নয়।

   দেবদেবীগণ যেহেতু ভগবানের প্রতিনিধি, তাই তাঁদের পূজা করা পরোক্ষভাবে ভগবানেরই পূজা করা হলেও তা যথার্থ বিধিসম্মত নয়- অবিধিপূর্বকম্। কারণ, সাধারণত অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন সকামকর্মীরাই জড় বিষয় লাভের বাসনায় দেবদেবীদের পূজা করে থাকে। প্রকৃত বিধান হলো সরাসরি ভগবানের পূজা করা। দেবদেবীদের পূজা যদি কেউ করতেও চান, তবে তার উদ্দেশ্য কোনো জড়বিষয় লাভের পরিবর্তে কেবল ভগবানের প্রতি ভক্তিলাভ বা তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই করা উচিত; ঠিক যেমন, ব্রজগোপিকারা কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য কাত্যায়নীর পূজা করেছিলেন। শুধু তাঁরাই নন, অর্জুনও শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্যই দুর্গাস্তব করেছিলেন। কৃষ্ণ সন্তুষ্টি এই অর্থে, যেহেতু কৃষ্ণ তা চেয়েছিলেন। আর উপরে উল্লেখিত কারণেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা চেয়েছিলেন। যদিও শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, শত্রুদের পরাজয়ের জন্য দুর্গাস্তব করো, কিন্তু এটা ছিল অর্জুনকে গীতাজ্ঞান দানের পূর্বে, যখন অর্জুন জানতেন না যে, শ্রীকৃষ্ণই পরমব্রহ্ম, যিনি দুর্গাদেবীরও আরাধ্য। সাধারণত জড়বিষয় সুখ লাভের জন্য মানুষ দুর্গাপূজা করে। অর্জুনও সেখানে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকায় উপনীত ছিলেন, তখনও শ্রীকৃষ্ণের ভক্তরূপে তাঁর প্রতি পূর্ণ শরণাগত হননি। তাই গীতাজ্ঞান দানের পূর্বে দুর্গার শ্রীমুখ থেকেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশের সূচনা করলেন যে, পা-বদের যুদ্ধজয়ের তথা সমস্তকিছুর তিনিই মূল কারণস্বরূপ স্বয়ং নারায়ণ। তাই সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণেরই শরণাপন্ন হওয়া উচিত। শত্রু পরাজয়ের জন্য শ্রীকৃষ্ণের কৃপা-সান্নিধ্যই যে মূল প্রয়োজন, তা দেবী দুর্গাই বলেছেন। তাই ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের অন্তিম উপদেশ ছিল-

মন্মনা ভব মদ্ভক্ত মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।

মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে ॥১৮.৬৫॥

“তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত করো, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা করো এবং আমাকে নমস্কার করো। তাহলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। এজন্য আমি তোমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।”

সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং মামেকং শরণং ব্রজ।

অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥১৮.৬৬॥

“সর্ব প্রকার জড় ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও, আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব, তুমি শোক করো না।”

কৃষ্ণপূজা এবং দুর্গাপূজা কি এক?

অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন কিছু লোক অল্পমেধসাম (গী.৭/২৩) যারা নিজেদের মহাপ-িত বলে লোক ঠকায়, তারা সমস্ত দেবদেবীকে ভগবানের বিভিন্ন রূপ বলে মনে করে এবং তাদের ভ্রান্ত প্রচারের ফলে জনসাধারণও সেকথা সত্য বলে মনে করে। প্রকৃতপক্ষে, এসমস্ত দেবদেবী ভগবানের বিভিন্ন রূপ নন, তাঁরা হচ্ছেন ভগবানের বিভিন্ন অংশবিশেষ। ভগবান হচ্ছেন এক, আর অবিচ্ছেদ্য অংশেরা হচ্ছেন বহু। বেদে বলা হয়েছে, নিত্যনিত্যানাম ভগবান হচ্ছেন এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর।” বিভিন্ন দেবদেবীও হচ্ছেন শক্তিপ্রাপ্ত যাতে তাঁরা এই জড় জগৎকে পরিচালনা করতে পারেন। এসমস্ত দেবদেবী হচ্ছেন জড়জগতের বিভিন্ন শক্তিসম্পন্ন জীব (নিত্যানাম্), তাই কোনো অবস্থাতেই তাঁরা ভগবানের সমকক্ষ হতে পারেন না। শুক্লযজুর্বেদ (৩২/৩) ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৪/১৯) তাই বলা হয়েছে, ন তস্য প্রতিমা অস্তি অর্থাৎ তাঁর (পরমেশ্বর ভগবানের) সমান বা তুল্য কেউ নেই। যে মনে করে যে, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীনারায়ণ ও বিভিন্ন দেবদেবী একই পর্যায়ভুক্ত, তার কোনোরকম শাস্ত্রজ্ঞান নেই। এমনকি দেবাদিদেব মহাদেব এবং আদি পিতামহ ব্রহ্মাকেও ভগবানের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। প্রকৃতপক্ষে শিব, ব্রহ্মা আদি দেবতারা ভগবানের সেবা করেন (শিববিরিঞ্চিনুতম্); কিন্তু তা সত্ত্বেও মানব সমাজে অনেক নেতা আছে, যাদের মূর্খ লোকেরা ‘ভগবানে নরত্ব আরোপ’- এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অবতার জ্ঞানে পূজা করে। কিন্তু ভগবান শ্রীনারায়ণ, শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর, তিনি এ জড় জগতে নাম, বিগ্রহ বা স্বয়ংরূপে আবির্ভূত হলেও জড় জগতের তত্ত্ব নন। তিনি জড় জগতের অতীত চিন্ময় জগতে নিত্য অবস্থান করেন।

   এমনকি মায়াবাদ দর্শনের প্রণেতা শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য বলে গেছেন, নারায়ণ অথবা শ্রীকৃষ্ণ এই জড় জগতের অতীত। কিন্তু সাধারণ লোকেরা (হৃতজ্ঞান) তা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিক ফল লাভ করার আশায় বিভিন্ন জড় দেবদেবীর পূজা করে চলে। এসমস্ত অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা বুঝতে পারে না, বিভিন্ন দেবদেবীকে পূজা করার ফলে যে ফল লাভ হয়, তা অনিত্য। যিনি প্রকৃত বুদ্ধিমান, তিনি ভগবানেরই সেবা করেন। তুচ্ছ ও অনিত্য লাভের জন্য বিভিন্ন দেবদেবীকে পূজা করা নিষ্প্রয়োজন। জড়া প্রকৃতির বিনাশের সঙ্গে-সঙ্গে এসমস্ত দেবদেবী এবং তাঁদের উপাসকেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। দেবদেবীদের দেওয়া বরও হচ্ছে জড় এবং অনিত্য। জড় জগৎ, জড় জগতের বাসিন্দা, এমনকি বিভিন্ন দেবদেবী এবং তাঁদের উপাসকেরা সকলেই হচ্ছে মহাজাগতিক সমুদ্রের বুদবুদের ন্যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এজগতের মানবসমাজ ভূসম্পত্তি, পরিবার পরিজন, ভোগের সামগ্রী আদি অনিত্য জড় ঐশ্বর্য লাভের আশায় উন্মাদ। এই প্রকার অনিত্য বস্তু লাভের জন্য মানবসমাজে কেউ-কেউ বিভিন্ন দেবদেবীর অথবা শক্তিশালী কোনো ব্যক্তির পূজা করে। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে পূজা করে যদি ক্ষমতা লাভ করা যায়, সেটিকে তারা পরম প্রাপ্তি বলে মনে করে। তাই তারা সকলেই তথাকথিত নেতাদের দ-বৎ প্রণাম করছে এবং তার ফলে তাদের কাছ থেকে ছোটখাটো কিছু আশীর্বাদও লাভ করছে। এসমস্ত অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা জড় জগতের দুঃখকষ্ট থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত হবার জন্য ভগবানের শরণাগত হতে আগ্রহী নয়। পক্ষান্তরে, সকলেই তাদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার জন্য ব্যস্ত এবং তুচ্ছ একটু ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার জন্য তারা দেবদেবীর আরাধনার প্রতি আকর্ষিত হয়। খুব কম মানুষই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণের শরণাগত হয়। অধিকাংশ মানুষই সর্বক্ষণ চিন্তা করছে- কীভাবে আরো বেশি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করা যায়। আর এসমস্ত ভোগবাসনা চরিতার্থ করার জন্য তারা বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে গিয়ে ‘এটা দাও’, ‘ওটা দাও’ বলে কাঙ্গালপনা করে তাদের সময় নষ্ট করছে।

এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত শ্লোকটি প্রণিধানযোগ্য-

যথা তরোর্মূলনিষেচনেন

তৃপ্যনিন্ত তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ।

প্রাণোপহারচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং

তথৈব সর্বার্হণমচ্যুতেজ্যা ॥ (ভাগবত ৪/৩১/১৪)

বৃক্ষমূলে জলসেচন করলে যেমন সেই গাছের কা-, ডাল, উপখাশা প্রভৃতি সকলেই তৃপ্তিলাভ করে এবং উদরে আহার্যদ্রব্য প্রদানের দ্বারা যেমন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে সমস্ত দেবতার পূজা হয়ে যায়। তখন ভগবানের বিভিন্ন অংশ দেবতারাও আপনা থেকেই তৃপ্ত হন। তাই কখনো দেবদেবী-পূজাকে ভগবদ্ভক্তির সমকক্ষ মনে করা উচিত নয়।

পরমেশ^র ভগবানকে বাদদিয়ে দুর্গাপূজার ফলে খুব বেশি হলে কৈলাশধাম প্রাপ্ত হওয়া যেতে পারে, কিন্তু বৈকুণ্ঠ বা গোলোকধামে গমন সম্ভব নয়। মাহেশ্বরা রাজসী চ বলিদানসমন্বিতা। শাক্তাদয়ো রাজসাশ্চ কৈলাসং যান্তি তে তয়া ॥ (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখ- ৬৪.৪৮॥ তাই দেবী দুর্গারই নির্দেশে সুরথ রাজা অন্তিমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই  আরাধনা করেছিলেন এবং ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

শাক্তগণ বলেন, “যিনি কালী বা দুর্গা, তিনিই কৃষ্ণ”। শাস্ত্রানুসারে, দেবী কালী ভগবানের শক্তি, আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন সর্বশক্তিমান পরমেশ^র ভগবান। আগুন তাপ ও আলো উভয় শক্তির উৎস। অর্থাৎ, তাপ ও আলো শক্তি দুটো আগুনের প্রকাশ- আগুন শক্তিমান, তাপ ও আলো শক্তি। তেমনি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনন্তশক্তির মধ্যে তিনটি প্রধান শক্তি হলো অন্তরঙ্গা, বহিরঙ্গা ও তটস্থা শক্তি। দেবী কালী হলেন শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা মায়াশক্তি দুর্গার উগ্ররূপা প্রকাশ, যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ সংহারকার্য সম্পাদন করেন। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে-

সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়সাধনশক্তিরেকা ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা।

ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্টতে সা গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥

“স্বরূপশক্তি বা চিৎশক্তির ছায়া-স্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-সাধিনী মায়াশক্তিই ভুবনপূজিতা ‘দুর্গা’, তিনি যাঁর ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখ-ে (১.৯০) কালী সম্পর্কে বলা হয়েছে-

‘কৃষ্ণভক্তা, কৃষ্ণতুল্যা তেজসা বিক্রমৈর্গুণৈঃ।

কৃষ্ণভাব নয়া শশ্বৎ কৃষ্ণবর্ণা সনাতনী’।

অর্থাৎ, “দেবীকালী তেজ ও গুণ বিক্রমে কৃষ্ণতুল্যা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি কৃষ্ণ ভক্তিপরায়ণা তথা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত (বৈষ্ণবী)। এই সনাতনী নিরন্তর কৃষ্ণের ভাবনাবশত কৃষ্ণবর্ণ হয়েছেন।”

ভক্তের মধ্যে ভগবানের সমস্ত দিব্যগুণ বিকশিত হয়, তথাপি ভক্ত ও ভগবান দুই ভিন্ন সত্ত্বা। ভগবান সেব্য, আর ভক্ত হলেন তাঁর সেবক। তেমনি দেবীকালী হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবিকা। একেলা ঈশ^র কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য। যারে যৈছে নাচায়, সে তৈছে করে নৃত্য ॥ সুতরাং, কালী তথা দুর্গা ও কৃষ্ণ এক নয়।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *