শ্রীল প্রভুপাদের পাশ্চাত্য বিজয়

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ইতিহাসে কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের পাশ্চাত্যদেশযাত্রা এক নবযুগের সূচনা করেছে। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শ্রীধাম নবদ্বীপে যে সংকীর্তন আন্দোলনের বীজ রোপন করেছিলেন, আজ সেই বৃক্ষ কেবল নবদ্বীপ তথা ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি নগরাদি গ্রামে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বে অগণিত জীব আজ সেই সংকীর্তন বৃক্ষের প্রেমফল আস্বাদন করে চৈতন্যাবতারের প্রেমামৃত বন্যায় ভাসছে। ভগবান সর্বদাই তাঁর ভক্তকে মহিমান্বিত করে আনন্দ পান; সেকারণেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর অন্যতম প্রিয় সেনাপতি-ভক্ত শ্রীল প্রভুপাদের দ্বারা তাঁর অবশিষ্ট কাজের পূর্ণতা সাধন করেছিলেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁর নিত্যধর্ম-সূর্যোদয় প্রবন্ধে এর সূত্র স্থাপন করে গেছেন। কৃষ্ণভাবনার সেই নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬৫ সালের ১৩ আগস্ট শ্রীল প্রভুপাদের আমেরিকা যাত্রার মাধ্যমে। আজ শ্রীল প্রভুপাদের আমেরিকা যাত্রার সুবর্ণ জয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর পূর্তি। আমেরিকার টমস্কিন স্কয়ার পার্ক থেকে শুরু হওয়া শ্রীল প্রভুপাদের অগ্রযাত্রা আজ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

শ্রীল প্রভুপাদের পূর্বে বহু ব্যক্তি পাশ্চাত্যে বৈদিক তত্ত¡দর্শন প্রচার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচার করতে গিয়ে উল্টো তাদের সংস্কৃতির দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে ফিরে এসেছে, কেউবা বৈদিক তত্ত¡দর্শনের নামে নিজেদের মনগড়া জল্পনা কল্পনা দ্বারা কিছু বক্তৃতা দিয়ে সস্তা বাহ্বা পেয়েছেন, আবার কেউ প্রচার করতে গিয়ে অসম্ভব বলে ফিরে এসেছেন। তাদের মধ্যে কেউই পাশ্চাত্যবাসীদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে পারেনি; পারেনি বৈদিক তত্ত¡দর্শনের জ্ঞানের আলোকবর্তিকা দ্বারা লক্ষ লক্ষ দিগ্ভ্রান্ত মানুষের অজ্ঞান অন্ধকারের অবসান ঘটাতে।

শ্রীল প্রভুপাদের এ অসামান্য অবদানকে স্মরণীয় করতে আমরা এ প্রবন্ধে জানবো শ্রীল প্রভুপাদের সফলতা বা পাশ্চাত্যযাত্রার পেছনে লুকিয়ে থাকা তাঁর কঠোর সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের ইতিকথা।    

১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তিনি আবিভর্‚ত হন। অভয়চরণের ১৫১ নং হ্যারিসন রোডের বাড়িটি ছিল উত্তর কলকাতায়। তাঁর পিতৃদেব শ্রীযুক্ত গৌরমোহন দে সম্ভ্রান্ত সুবর্ণবণিক সমাজের একজন সচ্ছল কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল রজনী দেবী। আর তাঁর নাম রাখা হয় অভয়চরণ দে। বাঙালি ঐতিহ্য অনুসারে তাঁর পিতামাতা এক জ্যোতিষীকে দিয়ে শিশুপুত্রের ঠিকুজি করিয়েছিলেন। সেই জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তাঁর বয়স যখন ৭০ বছর হবে, তখন তিনি সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাবেন, এক বিখ্যাত ধর্মপ্রচারকরূপে স্বীকৃতি লাভ করবেন এবং ১০৮টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন।

গুরুদেবের কাছে পাশ্চাত্যযাত্রার আজ্ঞা প্রাপ্তি

১৯২২ সালে অভয়চরণের সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর গুরুদেব মহা তেজস্বী বৈষ্ণবাচার্য শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সঙ্গে। প্রথম দর্শনেই সরস্বতী ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেনÑ “তোমরা শিক্ষিত যুবক, তোমরা কেন সারা পৃথিবীতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করছ না?” তিনি অভয়কে দেখেই বুঝেছিলেন যে, তাঁর মধ্যে এক বিশাল সম্ভাবনা সুপ্ত রয়েছে, যা একদিন পৃথিবীব্যাপী এক মহান বিপ্লবের সূচনা করবে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ অভয় তখন প্রশ্ন করেছিলেনÑ “আপনার চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী কে শুনবে? আমরা পরাধীন দেশের অধিবাসী; প্রথমে ভারতকে স্বাধীন হতে হবে।” শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেনÑ “কৃষ্ণভাবনামৃত ভারতীয় রাজনীতির পরিবর্তনের অপেক্ষা করে না, আর তা কোনো শাসকের ওপর নির্ভরশীলও নয়।” অভয় এর আগে কখনো এত সহজ অথচ নির্ভীকভাবে কাউকে বৈষ্ণব দর্শন বিশ্লেষণ করতে শোনেননি।

১৯৩৫-এর নভেম্বরে বৃন্দাবনে রাধাকুÐে অভয়চরণের সঙ্গে তাঁর গুরুমহারাজের এক তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষাৎকার হয়। তিনি অভয়কে গভীর আবেগের সঙ্গে বলেছিলেনÑ “আমার কিছ্ ুবই প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল। যদি তুমি কোনোদিন অর্থ সংগ্রহ করতে পারো, পারমার্থিক বই ছাপিও”। কথাগুলো অভয়ের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল।

পাশ্চাত্য যাত্রার প্রস্তুতি

১৯৩৯ সালে অভয়চরণের প্রথম গ্রন্থ “গীতোপনিষদের সূচনা” তাঁর গুরুভ্রাতাদের স্বীকৃতি লাভ করে; তাঁরা অভয়কে ‘ভক্তিবেদান্ত’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। সে সময় ভারতের নির্মল আকাশে ঘনিয়ে এসেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘ। যুদ্ধপীড়িত নাগরিকদের জন্য পরমেশ্বর ভগবানের এক বিশেষ বার্তা প্রচারের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন অভয়চরণ।

তিনি একাই একটি পত্রিকা প্রকাশনার কাজে লেগে গেলেন। তা ছিল ইংরেজিতে, কারণ তাঁর বার্তা ছিল সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য। তিনি তার নাম দিলেন ‘ব্যাক টু গডহেড’। তাঁর আত্মবিশ্বাসও অত্যন্ত দৃঢ় ছিল, তাই যুদ্ধের সময় ধ্বংস আর মৃত্যুর মধ্যেও তিনি তাঁর পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ করতে পেরেছিলেন।

তিনি লেখালেখি করে কালাতিপাত করেছিলেন এবং যাদের কাছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার বাণী প্রচার করেছিলেন, তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। মুদ্রকের কাছ থেকে ছাপা পত্রিকাগুলো নিয়ে তিনি সেগুলো বিতরণের জন্য শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। একটি চায়ের দোকানের কাছে তিনি সেগুলো নিয়ে বসতেন; কেউ যখন তঁাঁর কাছে এসে বসত, তিনি তাকে সে পত্রিকা কেনার জন্য অনুরোধ করতেন।

দিল্লীতে ‘ব্যাক টু গডহেড’ ছাপাবার এবং বিক্রির জন্য অভয়চরণ স্থির করেছিলেন যে, তিনি নয়া দিল্লীর আশি মাইল দক্ষিণে পবিত্র বৃন্দাবন ধামে থাকবেন এবং বৃন্দাবনের শান্ত, আধ্যাত্মিক পরিবেশে থেকে তিনি তাঁর রচনার কাজ চালিয়ে যাবেন।

একদিন নিঃস্ব এবং অসহায় অভয়চরণ ‘বৃন্দাবনে ভজন’ নামে একটি বাংলা কবিতা লিখেছিলেন। তার কতগুলো পঙক্তি খুবই মর্মস্পর্শী। যেমনÑ   

অর্থহীন দেখি মোরে ছেড়েছে সবাই।

কুটুম্ব, আত্মীয় আর বন্ধুজন ভাই \

দুঃখ হয় হাসি পায়, একা বসে হাসি।

মায়ার সংসার এই কাকে ভালবাসি?

বৃন্দাবনে শ্রীল প্রভুপাদ

বৃন্দাবনে যমুনার তীরে বংশী গোপালজীর মন্দিরে তিনি খুব স্বল্প ভাড়ায় সাধারণ একটি ঘর নিয়েছিলেন, আর বৃন্দাবনেই তিনি এক বৈশিষ্টপূর্ণ জীবন শুরু করেছিলেন। এক রাতে অভয়চরণ সেই স্বপ্নটি দেখলেন যা পূর্বে গৃহস্থ-আশ্রমে অবস্থানকালে কয়েকবার তিনি দেখেছিলেন। স্বপ্নে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর আবিভর্‚ত হয়েছিলেন, ঠিক যেভাবে তিনি তাঁকে জানতেনÑ সরাসরি পারমার্থিক জগৎ থেকে আগত সুপুরুষ সুপÐিত এক সন্ন্যাসী, যিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে এসেছিলেন। তিনি এসে অভয়চরণারবিন্দ প্রভুকে বলেছিলেন তাঁকে অনুসরণ করতে। বারবার তিনি তাঁকে ডেকেছিলেন। তিনি তাঁকে সন্ন্যাস নেয়ার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেনÑ “এসো, সন্ন্যাস গ্রহণ করো।” অভয়চরণ চমকে জেগে উঠলেন। এ স্বপ্নটিকে তিনি ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের আদেশ বলে মনে করেছিলেন। ১৯৫৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মথুরার কেশবজী গৌড়ীয় মঠে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতা শ্রীল ভক্তিপ্রজ্ঞান কেশব মহারাজের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর তাঁর নাম হয় শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী।

বৃন্দাবনে কিছুকাল থাকার পর তিনি পুনরায় দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখান থেকে শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী বৃন্দাবন এবং নয়া দিল্লী উভয় জায়গাতেই কাজ করতে পারছিলেন। কিছু সাহায্য সংগ্রহ করে তিনি পূর্ণোদ্যমে ‘ব্যাক টু গডহেড’ প্রকাশ এবং শ্রীমদ্ভাগবতের ইংরেজি অনুবাদ ও ভাষ্য রচনা শুরু করেছিলেন।

 তারপর  তিনি বৃন্দাবনে রাধাদামোদর মন্দিরে অবস্থান করেন। শ্রীশ্রী রাধাদামোদর মন্দিরেই তিনি ইস্কন প্রতিষ্ঠার ধারণা লাভ করেন। সেখানে তিনি একান্তে ভজন করতেন এবং কৃষ্ণভাবনা প্রচারের জন্য আচার্যদের কাছ থেকে শক্তি প্রার্থনা করতেন।  

শ্রীল রূপ গোস্বামীর কাছ থেকে পাশ্চাত্য যাওয়ার কৃপা প্রাপ্তি

বৃন্দাবনে রাধা দামোদর মন্দিরে অবস্থানকালে তিনি শ্রীল রূপ গোস্বামীর দর্শন লাভ করেন। শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের ব্যক্তিগত সচিব শ্রীহরিসৌরি প্রভুর সাথে তৎকালীন রাধাদামোদর মন্দিরের গোবিন্দচাঁদ নামে এক ভক্তের সাক্ষাৎকারে নি¤েœাক্ত ঘটনার কথা জানা যায় :

গোবিন্দ চাঁদ তখন তরুণ ছিলেন। শ্রীশ্রী রাধা দামোদর মন্দিরের যে ঘরে শ্রীল প্রভুপাদ থাকতেন সে ঘরের বারান্দায় শ্রীল প্রভুপাদ প্রায়ই জপ করতেন। একদিন তিনি দেখতে পান একটি ছেলে মন্দিরের প্রণামী বক্স থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তখন শ্রীল প্রভুপাদ তাকে টাকা চুরির কারণ জিজ্ঞেস করলে ছেলেটি বলে, তার মিষ্টি খেতে ভালো লাগে, তাই সে মিষ্টি কেনার জন্য সেখান থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তখন শ্রীল প্রভুপাদ বলেনÑ “আমি যদি তোমায় মিষ্টি বানিয়ে দিই তবে কি তুমি আবার চুরি করবে?” তখন ছেলেটি চুরি না করতে রাজি হয়। তারপর থেকে প্রতিদিন শ্রীল প্রভুপাদ ছেলেটিকে মিষ্টি (প্যাড়া) তৈরি করে খাওয়াতেন। তখন থেকে ছেলেটি শ্রীল প্রভুপাদের অনুগত হয়ে যায়।

একদিন সন্ধ্যায় শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর কক্ষে শুয়ে আছেন, তাঁর শরীর ততটা ভালো ছিল না। ছেলেটি শ্রীল প্রভুপাদকে জিজ্ঞেস করে, তাঁর কিছু লাগবে কি না। প্রভুপাদ বলেন, কিছু লাগবে না।

সে রাতে রাধাদামোদর মন্দিরের প্রধান দরজা লাগানো হয়ে গেছে। সাধারণত মন্দির লাগানোর পর কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। যে ঘরগুলো মন্দিরের ভেতরে ছিল, সেখানকার সকলেই তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন ছেলেটি (গোরাচাঁদ গোস্বামী) শ্রীল প্রভুপাদের কক্ষ থেকে শ্রীল প্রভুপাদ ছাড়াও অপরিচিত আরেকটি কন্ঠস্বর শুনতে পেলো। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর সাথে কথা বলছিলেন। তখন ছেলেটি দেখলো শ্রীল প্রভুপাদের কক্ষের  দরজার ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

পরদিন ছেলেটি শ্রীল প্রভুপাদের কাছে সে রাতের ঘটনা সম্বন্ধে জানতে চাইলে শ্রীল প্রভুপাদ বলেন যে, “গতরাতে শ্রীল রূপ গোস্বামী কৃপা করে আমাকে দর্শন দিয়েছেন।” শ্রীল রূপ গোস্বামীর সঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদের কী কথা হয়েছিল জানতে চাইলে শ্রীল প্রভুপাদ বললেন যে, রূপ গোস্বামী তাঁকে বলেছেনÑ

“তুমি কোনো চিন্তা করো না। পাশ্চাত্য দেশে প্রচার করার জন্য এগিয়ে যাও। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী তথা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র বিশ্বব্যাপী প্রচার করো। আমি কথা দিচ্ছি তুমি অবশ্যই সফল হবে; কারণ, আমি সর্বদাই তোমার পাশে থাকব।”

শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদের এ আশীর্বাদ শিরে ধারণ করে শ্রীল প্রভুপাদ মহাপ্রভুর বাণী প্রচারে আরো উৎসাহের সাথে নিযুক্ত হলেন। তিনি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতেন যে, আধুনিক দিগ্ভ্রান্ত সমাজে শ্রীমদ্ভাগবত এক বিপ্লব বয়ে আনবে। ক্রমে ক্রমে চাঁদা ও দান সংগ্রহ করে নিজের খরচেই তিনি শ্রীমদ্ভাগবত প্রকাশ করেছিলেন। টাকার অভাব সত্তে¡ও শুধু তাঁর অদম্য অধ্যবসায়ের ফলে দুবছরেরও কম সময়ে তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের তিনটি খÐ প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। তৃতীয় খÐটি ছাপা হবার পর তাঁর মনে হয়েছিলÑ তিনি এখন যাবার জন্য প্রস্তুত; যদিও তিনি তখন প্রায় কপর্দকহীন এবং তাঁর বয়স তখন ঊনসত্তর বছর, তথাপি তখনই তিনি যাত্রা করতে চেয়েছিলেন।

জাহাজের টিকেট প্রাপ্তি

শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর গ্রন্থ রচনা এবং বিতরণের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। এভাবে তিনি খুব শীঘ্রই তাঁর দেশবাসীদের মধ্যে বিদগ্ধ মহলে একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা ছিল পাশ্চাত্য দেশে যাবার। ভাগবতের তৃতীয় খÐটি মুদ্রিত হয়ে যাবার পর তিনি মনে করলেন যে, তিনি যাবার জন্য তৈরি হয়েছেন। তিনি এখন ঊনসত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধ, তাই তাঁর এক্ষুণি যাত্রা করা উচিত। শ্রীল প্রভুপাদ বৃন্দাবনে মথুরার ব্যবসায়ী মিঃ আগরওয়ালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি পাশ্চাত্য দেশে যেতে চান, যা তিনি প্রায় সকলকেই বলতেন। মিঃ আগরওয়াল যদিও শ্রীল প্রভুপাদকে মাত্র মিনিট কয়েক আগেই চিনেছিলেন, তবুও তাঁর আমেরিকায় যাবার জন্য তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পেনসিলভেনিয়াতে তাঁর ইঞ্জিনিয়ার ছেলে গোপালকে লিখে পাঠালেন যে, সে তাঁকে জামিন হওয়ার একটি ফর্ম পাঠাতে পারবে কি না। মিঃ আগরওয়াল যখন এভাবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁকে সাহায্য করতে লাগলেন, শ্রীল প্রভুপাদ তখন অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন যে, তিনি যেন দয়া করে তা করেন। শ্রীল প্রভুপাদ দিল্লীতে ফিরে এলেন, প্রশস্ত রাজপথে আগের মতো বই বিক্রি করে যেতে লাগলেন এবং কিছু সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। একদিন তিনি বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে সম্পর্কিত হলেন এবং খবর পেলেন যে, তাঁর বিদেশ ভ্রমণের সমস্ত কিছু তৈরি। এখন শ্রীল প্রভুপাদ একজনকে জামিনরূপে পেলেন। কিন্তু এখনও তাঁর পাসপোর্ট, ভিসা, পি ফর্ম এবং যাতায়াত ভাড়ার প্রয়োজন। পাসপোর্ট এবং জামিনের কাগজপত্র নিয়ে শ্রীল প্রভুপাদ বোম্বে গেলেন। শ্রীল প্রভুপাদ ‘ঝপরহফরধ ংঃবধসংযরঢ় ষরহব’ – এর প্রধান শ্রীমতী সুমতি মোরারজীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন, যিনি শ্রীমদ্ভাগবতের দ্বিতীয় খÐটি ছাপাবার জন্য অনেক অর্থ দান করে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ সুমতি মোরারজীর সেক্রেটারি মিঃ চোক্সীকে তাঁর জামিনের সমস্ত কাগজপত্র দেখালেন এবং তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং শ্রীল প্রভুপাদের পক্ষ থেকে মিসেস মোরারজীর কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে শ্রীল প্রভুপাদের সব কথা খুলে বলেন। মিসেস মোরারজী বলেছিলেন, না, স্বামীজী এতই বৃদ্ধ যে, তাঁর পক্ষে আমেরিকায় গিয়ে কোনো কাজ সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন করা অসম্ভব। মিসেস মোরারজীর কথাগুলো মি. চোক্সী শ্রীল প্রভুপাদকে বললেন, কিন্তু তিনি অত্যন্ত উদাসীনভাবে কথাগুলো শুনলেন। মিসেস মোরারজী চাইছিলেন যে, তিনি ভারতেই থাকুন আর শ্রীমদ্ভাগবত সম্পূর্ণ করুন। কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদ যাওয়াই স্থির করেছিলেন। তিনি শ্রীমতি মোরারজীকে রাজী করানোর জন্য মি. চোক্সীকে আরেকবার তার কাছে যেতে বলেন।  শ্রীমতী মোরারজী পুনরায় অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তারপর শ্রীল প্রভুপাদ নিজেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দৃঢ়প্রত্যয়ী প্রভুপাদ খুব জোরালোভাবে অনুরোধ করেছিলেন, “অনুগ্রহ করে আমাকে একটি টিকিট দিন।” সুমতি মোরারজী উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিলেন, “স্বামীজী, আপনি প্রবীণ, আপনি কেন এই দায়িত্ব নিচ্ছেন। আপনার কি মনে হয় এটি ঠিক কাজ হচ্ছে?” প্রভুপাদ তঁাঁর হাত তুলে উদ্বিগ্ন কন্যাকে সন্তুষ্ট করার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “না, সবই ঠিক আছে।” প্রভুপাদ আবারও একটি টিকিটের জন্য তাকে অনুরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত মোরারজী রাজী হলেন। শ্রীমতী মোরারজীর নির্দেশানুসারে তাঁর সেক্রেটারি সমস্ত বন্দোবস্ত করেছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদের অনুরোধে মিঃ চোক্সী মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের লেখা আটটি শ্লোক সমন্বিত পাঁচশ প্রচারপত্র এবং শ্রীমদ্ভাগবতের একটি বিজ্ঞাপন মুদ্রিত করে দিয়েছিলেন। শ্রীমতী মোরারজী ১৩ আগস্ট কলকাতা থেকে ছেড়ে যাবার জন্য নির্ধারিত তাঁর ‘জলদূত’ জাহাজে প্রভুপাদের জন্য একটি স্থান সংরক্ষণ করেছিলেন। মিঃ চোক্সী বোম্বেতে শেষ দুদিন প্রভুপাদের সঙ্গে অতিবাহিত করেছিলেন এবং প্রভুপাদকে কলকাতাগামী ট্রেন ধরিয়ে দেবার জন্য তিনি স্টেশন পর্যন্ত গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছিলেন। 

আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা

গোলোকবিহারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ কলিযুগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে অবতীর্ণ হয়ে ঘোষণা করেছিলেন যেÑ

পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম।

সর্বত্র প্রচার হইবে মোর এই নাম \

হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের কীর্তন ভারতের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বের প্রতিটি নগরে ও গ্রামে প্রচারিত হবে। তারপর শত শত বছর কেটে গেছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ঐকান্তিক ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে, কবে এবং কীভাবে তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক হবে।

তারপর ১৯৬৫ সালের ১৩ আগস্ট, বিদগ্ধ পÐিত, দার্শনিক এবং সন্ন্যাসী শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী তাঁর ঊনসত্তরতম জন্ম দিবসের কয়েকদিন পূর্বে সেই ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক করার লক্ষ্যে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। একটি ভারতীয় জাহাজ কোম্পানির কাছ থেকে সৌজন্য হিসেবে একটি টিকিট সংগ্রহ করে তিনি ‘জলদূত’ নামক একটি মালবাহী জাহাজের একমাত্র যাত্রীরূপে আরোহণ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিল একটি স্যুটকেস, একটি ছাতা, কিছু শুকনো চিড়া, প্রায় সাত ডলার মূল্যের ভারতীয় মুদ্রা এবং বেশ কয়েকটি গ্রন্থপূর্ণ বাক্স। বাকি অংশ ৩৩ পৃষ্ঠায় …

জলদূতে শ্রীল প্রভুপাদ

‘জলদূত’ হচ্ছে সিন্দিয়া স্টীম নেভিগেশন কোম্পানির একটি মালবাহী জাহাজ, কিন্তু তাতে একটি যাত্রী কেবিন আছে ১৯৬৫ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে নিউইয়র্ক যাবার সময়ে সেই কেবিনটিতে যাত্রী ছিলেন শ্রীঅভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী, খাতায় তাঁর বয়স লেখা ছিল ৬৯ বছর এবং ভাতা সমেত একটি কমপ্লিমেন্টারি টিকিটে তিনি আমেরিকা যাচ্ছিলেন।

 ‘জলদূতের’ নেতৃত্ব করছিলেন ক্যাপ্টেন অরুণ পাÐিয়া, তাঁর স্ত্রীও সেই জাহাজে ছিলেন। ১৩ আগস্ট, শুক্রবার সকাল নয়টায় জাহাজ ছাড়ল। তাঁর ডায়েরিতে প্রভুপাদ লিখেছেন, “কেবিনটি বেশ আরামদায়ক, সুমতি মোরারজীকে এসব বন্দোবস্ত করতে অনুপ্রাণিত করার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি বেশ আরামেই আছি।” কিন্তু ১৪ তারিখে তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, “সামুদ্রিক পীড়ায় ভুগছি, মাথা ঘুরছে, বমি হচ্ছে Ñ বঙ্গোপসাগরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। শরীর আরো খারাপ।” 

১৯ তারিখে জাহাজ যখন শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরে পৌঁছল, প্রভুপাদ তখন তাঁর সামুদ্র্র্রিক পীড়া থেকে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন তাঁকে সঙ্গে করে তাঁর ভূমিতে নিয়ে গেলেন এবং তিনি গাড়িতে করে কলম্বো শহরটি ঘুরে বেড়ালেন। তারপর জাহাজ ভারতের পশ্চিম উপক‚লে কোচিনের দিকে যাত্রা শুরু করল। সে বছর শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি ‘জন্মাষ্টমী’ ছিল আগস্ট মাসের ২০ তারিখে। এই সুযোগ নিয়ে প্রভুপাদ জাহাজের নাবিকদের কাছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তত্ত¡দর্শন শোনালেন এবং পরে তাঁর নিজের হাতে রান্না করা প্রসাদ বিতরণ করলেন। ২১ শে আগস্ট ছিল তাঁর সপ্ততিতম জন্মদিবস। অনাড়ম্বরে তা সমুদ্রের বুকে উদ্যাপিত হলো। সেদিনই জাহাজ কোচিনে পৌঁছল এবং বোম্বে থেকে সমুদ্রপথে পাঠানো প্রভুপাদ অনুদিত ‘শ্রীমদ্ভাগবত, গ্রন্থ-বোঝাই তিনটি ট্রাঙ্ক জাহাজে তুলে নেওয়া হলো। ২৩ তারিখের মধ্যেই জাহাজ লোহিত সাগরে এসে পড়ল। সেখানে কিন্তু প্রভুপাদকে অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছিল। তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেনÑ “বৃষ্টি, সামুদ্রিক পীড়া, মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, অরুচি, বমি,” Ñ তাঁর এই অসুস্থতার লক্ষণগুলোর কোনোই উপশম হলো না এবং মামুলি ‘সামুদ্রিক পীড়া’ থেকে তাঁর এ অসুখটি অন্য ধরনের এবং অনেক গুরুতর ছিল। তাঁর দুবার ‘হার্ট-অ্যাটাক’ হয়, কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল, আবার যদি এরকম একটি ‘অ্যাটাক্’ হয়, তাহলে তিনি আর তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। দ্বিতীয় রাতে প্রভুপাদ স্বপ্নে দেখেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি নৌকো বাইছেন এবং তিনি তাঁকে অভয় দিয়ে তাঁর কাছে আসতে বলছেন। প্রভুপাদ উপলদ্ধি করলেন যে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে রক্ষা করছেন এবং সেই যাত্রায় আর সেই রকম ‘হার্ট-অ্যাটাক’ তাঁর হয়নি। ১ সেপ্টেম্বর ‘জলদূত’ সুয়েজ খালে প্রবেশ করল এবং ২ সেপ্টেম্বর পোর্ট সৈয়দে নোঙর ফেলল। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে সেদিন তিনি শহরে বেড়াতে গিয়েছিলেন এবং সেই শহরটি তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। ৬ তারিখের মধ্যেই তাঁর অসুখ অনেকটা সেরে উঠল এবং দুসপ্তাহের মধ্যেই আবার তিনি আগের মতো নিজের হাতে চচ্চড়ি ও পুরি রান্না করে নিয়মিত আহার করতে লাগলেন। তিনি ডায়েরিতে লিখেছিলেন যে, তাঁর শরীরের বল আস্তে আস্তে ফিরে আসছে।

“আজ জাহাজ খুব সাবলীল গতিতে চলছে, আমি আগের চেয়ে অনেকটা ভালো বোধ করছি। কিন্তু আমি শ্রীবৃন্দাবনের বিরহ অনুভব করছি, আর অনুভব করছি আমার প্রাণনাথ শ্রীগোবিন্দ, গোপীনাথ, রাধা-দামোদরের বিরহ। তবু এ অবস্থায় আমার একমাত্র সান্ত¦না হচ্ছে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, যা অধ্যয়নে আমি, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলামৃতের আস্বাদন পাই। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে আমার গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করে আমি ভারতভ‚মি ত্যাগ করেছি। আমার কোনো যোগ্যতা নেই, কিন্তু আমার পরমারাধ্য গুরুদেবের আদেশ পালন করার জন্যই আমি এই দুঃসাহসিক কাজে ব্রতী হয়েছি। বৃন্দাবন থেকে বহু দূরে, কেবল তাঁদের কৃপার ওপর আমি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আছি।”

১৯৬৫ সালের জলদূতের সেই যাত্রা ছিল এক ধীর ও শান্ত জলযাত্রা। সে সম্বন্ধে জাহাজের ক্যাপ্টেন বলেছেন যে, তাঁর পুরো কর্মজীবনে তিনি জাহাজকে এত শান্ত এবং ধীরভাবে অতলান্তিক মহাসাগর পার হতে দেখেননি। তার উত্তরে প্রভুপাদ বলেছিলেন যে, সেই শান্ত, ধীরভাব শ্রীকৃষ্ণেরই করুণার নিদর্শন এবং শ্রীমতি পাÐিয়া প্রভুপাদকে অনুরোধ করেন, ফেরবার সময়ও তিনি যেন তাঁদের সঙ্গে আসেন, যাতে তাঁরা আবার এরকম শান্তভাবে অতলান্তিক পার হতে পারেন। প্রভুপাদ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেনÑ “অতলান্তিক যদি তার স্বাভাবিক রূপ ধারণ করত, তাহলে হয়ত আর বেঁচে থাকতাম না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণই ছিলেন জাহাজটির কাÐারি।”

পাশ্চাত্যে পদার্পণ

কলকাতা ছেড়ে পঁয়ত্রিশ দিন ভ্রমণের পর, ‘জলদূত’ ১৯৬৫, ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৫:৩০ মিনিটে বোস্টন কমনওয়েল্থ জেটিতে পৌঁছল। নিউইয়র্ক শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে জাহাজটি বোস্টনে কিছু সময় থেমেছিল। একটি পায়ে হাঁটা সেতু পেরিয়ে, কয়েকটি রাস্তা অতিক্রম করে প্রভুপাদ ক্যাপ্টেন অরুণ পাÐিয়ার সঙ্গে শহরের কেন্দ্রস্থলে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন পাÐিয়ার সেখানে কিছু কেনাকাটা করার ছিল। আমেরিকার মাটিতে প্রথম পদার্পণ করা ছাড়া, বোস্টনে প্রভুপাদের ক্ষণকালীন অবস্থানের আর একটি বিশেষ তাৎপর্য ছিলÑ তা হলো কমনওয়েল্থ জেটিতে ‘মার্কিনে ভগবৎ-ধর্ম’ নামে একটি বাংলা কবিতা তিনি লিখেছিলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ‘জলদূত’ নিউ ইয়র্ক বন্দরে পৌঁছে ব্রæকলীন বন্দরে নোঙর ফেলল। প্রভুপাদের জাহাজ-বাস শেষ হলো। সে সময়ের কথা বর্ণনা করে প্রভুপাদ পরে বলেছেন যে, জাহাজ থেকে নেমে তিনি যে কোথায় যাবেন, কি করবেনÑ সেই সম্বন্ধে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। জেটিতে নেমে ডানদিকে যাবেন, না বাঁদিকে যাবেন, তা তিনি জানতেন না। তাঁর সম্বল তখন কেবল চল্লিশ রুপি, যা নিউ ইয়র্কে মাত্র কয়েক ঘণ্টার খরচ। প্রভুপাদের পরনে প্রকৃত ব্রজবাসীর পোশাক। তাঁর গায়ের রঙ সোনালি, কপালে সুন্দর করে তিলক কাটা, পরনে একটি সুতির বহির্Ÿাস এবং গায়ে চাদর, গলায় কণ্ঠিমালা, হাতে জপমালা, পায়ে একজোড়া সাদা রবারের জুতো, যা ভারতবর্ষের সাধুদের পায়ে দেখা গেলেও আমেরিকায় কেউ কখনো দেখেনি। নিউইয়র্কে কেউ কখনো স্বপ্নেও এরকম বৈষ্ণবকে দেখার কল্পনা করেনি। জাহাজ থেকে নামার পর প্রভুপাদ সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেন। পেনসিলভেনিয়ার কোনো এক জায়গায় মি. আগরওয়াল নামে তাঁর একজন জামিনাদার ছিল। তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন যে, তাঁকে নেওয়ার জন্য অবশ্যই কাউকে পাঠাবেন। ডক থেকে বেরিয়ে এসে তিনি দেখলেন যে, তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মি. আগরওয়াল ‘ট্রাভেলার্স এডের’ একজন প্রতিনিধিকে পাঠিয়েছেন।  সেই চল্লিশ রুপি এবং আরো বিশ ডলার, যা তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের তিনটি খÐ ক্যাপ্টেন পাÐিয়ার কাছে বিক্রি করে সংগ্রহ করেছিলেন, সেই সামান্য সম্বল নিয়ে শ্রীল প্রভুপাদ ছাতা ও একটি স্যুটকেস হাতে নিয়ে ‘ট্রাভেলার্স এডের’ প্রতিনিধির সঙ্গে বাটলার যাওয়ার উদ্দেশ্যে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালের দিকে রওনা হলেন। তারপর শুরু হলো শ্রীল প্রভুপাদের নতুন সংগ্রাম। এক চরম সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম করে শ্রীল প্রভুপাদ পাশ্চাত্য বিজয়ের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

ইস্কন প্রতিষ্ঠা

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক শহরে পৌঁছানোর পর শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর ভগবৎ-চেতনাময় সংঘ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথম বছর একাকী তীব্র সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন, যখন যেখানে সুযোগ পেতেন ভাষণ দিতেন। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর শিক্ষার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকে।

১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্ক শহরের লোয়ার ইস্ট সাইড-এ অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত দোকান ঘরে থেকে যখন তিনি একাকী তাঁর প্রচারকার্য সম্পাদন করেছিলেন, তখন তিনি সারা পৃথিবীতে ভগবানের বাণী প্রচার করার উদ্দেশ্যে একটি পারমার্থিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সে সংস্থার নাম দেন “ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাস্নেস’’ বা “আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ’’, সংক্ষেপে “ইস্কন”।

সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার সময় শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে পূর্ণরূপে যুক্ত একজন অনুগামীও ছিল না। নিরুৎসাহিত না হয়ে তিনি তাঁর সান্ধ্য ভাষণের সভায় উপস্থিত কতিপয় শ্রোতার মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবক মনোনয়ন করে ইস্কনের প্রথম ট্রাস্টিপদে তাদের নিয়োগ করেন। সেটি ছিল তখনকার অবস্থা, আর এখন সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের ৩০০টিরও অধিক মন্দির, পল্লী-সমাজ, বিদ্যালয়, বিশেষ প্রকল্প এবং লক্ষ লক্ষ অনুগামী রয়েছে যারা প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *